Onlyfan Premium Videos

অপ্রেমের কাব্য-৫

 

গল্প:-অপ্রেমের কাব্য-৫

লেখক:- আরভান শান আরাফ



ইজহার অনেক ভাবলো। চিঠিটা বার কয়েক উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখলো৷ সুন্দর হাতের লেখা৷ মুক্তোর মত প্রতিটি অক্ষর। কিন্তু এত বড় চিঠি কে লিখবে?ইজহার অনেক ভেবে চিঠিটা পড়তে শুরু করল-

জনাব মেয়র,

চলে যাচ্ছি। এ কয়েক দিন আপনাদের খুব কষ্ট দিলাম। বিশেষ করে আপনাকে৷ তবে আপনাদের আপ্যায়নে আমি মুগ্ধ। আমাদের বাড়ি তো কখনো যাবেন না,যদি যান তবে সুদে আসলে তা ফেরত দিয়ে দিব। যে স্নেহ আর মমতা আপনার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি তার মোহে আমি দীর্ঘদিন আবিষ্ট হয়ে থাকব। আপনাকে বুঝা কঠিন। কখনো মনে হয় আপনি জলের মত তরল আবার কখনো মনে হয় আপনি ইস্পাত সদৃশ্য মানুষ৷ এত কাঠিন্যতা কেন আপনার মধ্যে?আপনি মেয়র এই জন্য?

চিঠি লেখার ইচ্ছে ছিল না। তবে কিছু কথা বলতে মন কেমন উশখুশ করছিল। আপনি কি জানেন,আপনার কারনে আমার গ্রাম ছাড়তে হয়েছে৷ আমার মা বাবা কত কষ্ট পেয়েছেন৷ আপনার জন্য আমার পা ভেঙ্গেছিল,আর এই কারনে আমাকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তে হচ্ছে৷ আপনার জন্য আমার গুছানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে৷ কিন্তু আজকাল আপনার প্রতি আমার কোন রাগ নেই৷ আমি সব কিছু মেনে নিয়েছি৷ যাইহোক,চিঠি লেখায় কিছু মনে করবেন না৷ রেগে গিয়ে আবার আমায় জেলে পাঠিয়ে দিবেন না যেন। 

চলে যাচ্ছি৷ ভালো থাকবেন৷ 


ইজহার একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চিঠিটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে রেখে দিল৷ তার মন বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেছে।তার ভুলের কারনে মুহীন তাকে এত অপছন্দ করে৷ আসলে ই তো, তার এমন উচিত হয়নি৷ অতিরিক্ত রাগ হয়তো এভাবে ই সবার কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে।মুহীনের প্রতি তার যে টান বা মায়া তা হয়ত ইজহার মুহীনকে বলতে পারবে না৷ কিন্তু এই টান বা আবেগটা যে হুট করে মন থেকে বিলীন হয়ে যাবে তা ও কিন্তু নয়৷ সে একি রকম আবেগ এর আগে ও একজনের প্রতি দেখিয়েছিল। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল৷ কিন্তু সেই স্বপ্ন তার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে৷ এখন মুহীনের প্রতি তার যে এক তরফা ভালো লাগা সেটা তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা একমাত্র ইশ্বর ই জানে৷ ইজহার কখনো কি মুহীনকে বলতে তার মনের কথা?আর বললে ও কি মুহিন সেই চাওয়াটাকে গুরুত্ব দিবে?আর দিলে ই কী সমাজ কি মেনে নিবে?তার স্বপ্ন কি আদৌ পূরণ হবে?উলটো মুহীনের জীবনকে জটিলতায় ভরিয়ে দিবে। 

ইজহার আর ভাবতে পারছে না৷ তার মন আরো খারাপ হয়ে গেল৷ এত যন্ত্রনা আর নেওয়া যাচ্ছে না৷ কেন এমন হয় তার সাথে বারবার?কেন তার জীবন এত তিক্ততায় ভরা?


সেমিস্টার ব্রেক পড়ে গেছে৷ মুহীন এবার বাড়ি যাবে৷ কতদিন হয়ে গেল সে তার মা বাবাকে দেখে না৷ কত দিন হয়ে গেল মায়ের হাতে খাবার খায় না৷ বন্ধুদের সাথে সাইকেল নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু মুহীনের গ্রামে যেতে মন চাচ্ছে না৷ গেল রাতে সে একদম ঘুমাতে পারেনি। তার বারবার ইজহারের কথা মনে পড়েছে৷ সে কি চিঠিটা পড়েছে?কী ভাবছে সে চিঠি পড়ার পর?নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে কখন যে ভোর হয়ে গেল সেই খেয়াল নেই৷ নয়টার দিকে মুহীনের আপা মুহীনের রুমে একটা বক্স নিয়ে ঢুকলো। তার মুখ হাসি খুশি৷ আপাকে হাসি খুশি দেখলে মুহীনের এমনিতেই ভালো লাগে৷ বিছানা থেকে না উঠে বালিশটা সোজা করে হেলান দিয়ে বসতে বসতে মুহীন বলল

-কী আপা?ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে তো তুমি আরো সুন্দর হয়ে গেছ।

-তুই যা বলিস না, ভাই। দেখ তুর দুলাভাই কী নিয়ে আসছে তুর জন্য। 

মুহীন উৎসুক চোখে বাক্সের দিকে তাকিয়ে বলল

-এই বাক্সে কী আছে? চকলেট? 

-আহা! খোলে ই দেখ না৷

মুহীন বক্সটা ওর বোনের হাত থেকে নিয়ে খোলতে ই একটা চাবি বের হয়ে এলো৷ চাবি দেখে মুহীন বলল

-এটা কিসের চাবি?

তুই এক দৌড়ে গেইটের সামনে গিয়ে দেখে আয়। 

মুহীনের বুক কাঁপতে লাগলো। সে খালি শরীরে ই এক দৌড়ে গেইটের সামনে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাগ। কালো রঙের একটা বাইক দাঁড় করানো৷ মুহীন চিৎকার করে আপাকে ডাকতে লাগলো। মুহীনের আপা ছুটে এসে বলল

-কী পছন্দ হয়েছে?

-খুব খুব পছন্দ হয়েছে৷ কিন্তু হঠাৎ বাইক কেন?

-আরে!তুর সাইকেল ভেঙ্গে যাওয়ার পরে ই তুর দুলাভাই বাইক কিনে দিবে বলে ভেবে রেখেছিল। তাই এবার ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে এসেছে৷ পেপার করা বাকি৷ তুই কিন্তু পেপার ছাড়া বাইক নিয়ে রাস্তায় নেমে যাবি না৷ পেপার হোক। 

-আপু। একটু চালাই আজ?এই সামনে যাব শুধু৷ 

-নাহ। তুর দুলাভাই মানা করেছে। 

-এমন করো কেন?বললাম তো৷ শুধু চালিয়ে দেখব। 

মুহীনের অনুরোধে ওর আপু অনুমতি না দিয়ে পারল না। মুহীন আর দেরি না করে এক লাফে বাইকে চড়ে বসে চাবি ঢুকিয়ে দিল। মুহীন বাইক যে খুব ভালো চালায় তা নয়৷ আনাড়ি হাতে বাইক নিয়ে রাস্তায় নামতেই এক প্রাইভেট কারের সাথে গিয়ে ঘষা খেল৷ মুহীন অনেক কষ্টে বাইক আর নিজেকে সামলে যখন ফিরে তাকালো তখন দেখে ইজহার মাহমুদ সেই গাড়ি থেকে রাগিরাগি চেহারা নিয়ে নামছে। ভয়ে মুহীনের গলা অবধি শুকিয়ে গেল। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে ই সন্ধ্যা হয় টাইপের অবস্থা। সে কোন দিক দিয়ে দৌড়ে পালাবে তা ভাবতে লাগলো। বাইক নিয়ে পালাবে নাকি সেটা রেখে পালাবে তা ভাবতে না ভাবতেই ইজহার মাহমুদ তাকে ডাক দিল

-এই এদিকে আসো তো। কী করলে এটা?

মুহীন ভয়ে ভয়ে ফিরে তাকালো৷ ইজহার যখন দেখলো এটা মুহীন তখন তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো৷ তার রাগ নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল। খানিক আগে মানুষ খুন করার মত যে রাগটা ছিল সেটা কোমল এক অনুভূতিতে বদলে গেল।ইজহার কী মনে করে যেন রাগি রাগি চেহারা নিয়ে মুহীনকে টেনে গাড়ির সামনে এনে তার দাগটা দেখিয়ে বলল

-তুমি কী করেছে দেখ৷ এটা খরচ করতে কত লাগবে জান?

মুহীন ভয়ে ভয়ে বলল

-আমি দেখিনি৷ 

-দেখুনি কেন?বাইক চালানো না পারলে সেটা নিয়ে রাস্তায় বের হলে কেন?

-জ্বি?

-জ্বি কী?তোমাকে শাস্তি পেতে হবে৷ 

মুহীন এবার সত্য ই ভয় পেল৷ এই লোক না তাকে আবার পুলিশে দেয়। 

-কী শাস্তি দিবেন?

-কানে ধরে উঠবস করো। 

মুহীন মনে মনে ভাবলো বাঁচলাম। এই লোক যা ভয়াবহ, পারলে তাকে পুলিশে দিয়ে দিবে৷ এর চেয়ে ভাল অল্পের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে৷ মুহীন আর কথা না বাড়িয়ে ডানে বায়ে দেখে নিয়ে কানে ধরে উঠবস করতে লাগলো আর বিড়বিড় করে এক,দুই তিন গণনা করতে লাগলো। 

ইজহার মুহীনের কান্ডকারখানা দেখে পেছন ঘুরে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে গিয়ে গাড়িতে উঠলো। গাড়িতে উঠে মুহীনের কয়েক সেকেন্ডের একটা ভিডিও করে সেটা ইশার কাছে পাঠিয়ে ম্যাসেজ করলো যে

-দেখ ইশা,তুর বেস্ট ফ্রেন্ড মাঝরাস্তায় কানে ধরে উঠবস করছে। 

ইশা সেই ম্যাসেজের উত্তরে  লিখলো

-কাজটা একদম ঠিক করুনি ভাইয়া।বেচারা নিশ্চয় তোমার ভয়ে কানে ধরেছে। 

ইজহার হাসতে হাসতে আজ পৌরসভায় ঢুকেছে৷ ইজহারকে এমন হাসিখুশি পৌরসভার কাউন্সিলরা খুব কম ই দেখেছে।


মুহীনকে মুখ ভার করে ঢুকতে দেখে তার বোন দৌড়ে এলো। এত হাসিখুশি মুখ নিয়ে বের হওয়া মুহীন এমন মুখ ভার করে ঘরে ফিরলো কেন?মুহীন তার বোনকে দেখে ও না দেখার ভান করে সোজা তার রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দিল। তার মন খুব খারাপ। একটা মানুষ সব সময় তার সাথে এমন কেন করে সে বুঝে না৷মুহীন মনে মনে বার কয়েক শপথ করে নিল যে আর কোন দিন ইজহার মাহমুদের সামনে যাবে না। 

ইজহার কিছুক্ষণ পর পর রাস্তায় করা ভিডিও টা দেখছিল৷ নিষ্পাপ কিশোরের মত একটা ছেলে তার ভয়ে কান ধরে উঠবস করছে৷ তার কাঁদোকাঁদো চোখ মুখ যেন সৃষ্টি জগতের সকল সুখ বাঁধা৷ ইজহারের খেয়ালে বিঘ্ন ঘটালো ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সেলিম মিয়া।সে ভাল মানুষ৷ ইজহার মাহমুদের বাবার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল৷ সে চেয়ারে বসতে বসতে বলল

-মেয়র সাব,একটা কথা বলার ছিল। 

ইজহার শ্রদ্ধাভরে জিজ্ঞেস করল

-কী কথা কাকা?

-তোমাকে নিয়ে খুব চালাচালি হচ্ছে৷ এমপি সাবের ইচ্ছে তার পরে তুমি এমপি নির্বাচন করো৷দলীয়ভাবে সবাই এটা চায়লে ও শারমিন আর ওর ভাই গুটি চালাচ্ছে৷ শারমিন চাচ্ছে ওর ভাই এমপি নির্বাচন করুক আর ও মেয়র৷ তোমার প্রতি ওদের প্রচুর আক্রোশ। 

ইজহার খানিক মুচকি হেসে বলল

-কাকা,রাজনীতি আমি ও বুঝি৷ বুঝি বলে ই তো বাবার মৃত্যুর পরে মেয়র হওয়ার শূণ্য সম্ভাবনা থেকে নিজেকে মেয়র করেছি৷ এখন এমপি নির্বাচনে দলীয়ভাবে আমাকে দিবে কি দিবা না সেটা পরের বিষয়। আপনি ভাববেন না৷ আপনার যেমন আমার পাশে ছিলেন সে ভাবে থাকলে ই হবে। জাতীয় নির্বাচনের তো দু বছর বাকি। দেখা ই যাক কী হয়। যে সম্ভাবনা তাতে দেখাচ্ছে সামনের বার আমাদের সরকার ই ক্ষমতায় যাবে। এবার দল থেকে যাকে দেওয়ার দিবে৷ সেটা পরের বিষয়৷ 

ইজহার বাহিরে যা বলুক না কেন ভেতর ভেতরে সে রেগে যাচ্ছে। তার রাগ কখন সীমা অতিক্রম করবে সেটা সে নিজে ও জানে না। সে বাসায়  ফিরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলে ও মন শান্ত হয়নি তার। 


সেদিন বিকেলে ইশা এক্সট্রা ক্লাস করে ফেরার সময় মুহীনকে প্রায় টেনে হিচড়ে তাদের বাসায় নিয়ে এলো। মুহীন যতটুকু জানে,এই সময় ইজহার বাসায় থাকে না।তাই সে আর খুব মানা করেনি।ইশা মুহীনকে সোফায় বসিয়ে ওর মাকে ডাকতে গেল। মুহীন ডেস্কে রাখা খবরের কাগজ পড়ছিল৷ হঠাৎ তার বুক ধুক ধুক করে কেঁপে উঠল৷ সে জিভে কামড় দিয়ে মনে মনে বলল

-এই রে,ইজহার মাহমুদ আজ বাড়িতে৷ 

সে আড় চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে ইজহার নিচের দিকে নামছে৷ মুহীন বাঘ দেখার মত ভয়ে চমকে গিয়ে এক লাফে সোফার পেছনে গিয়ে লুকালো। ইজহারের মন আজ যতেষ্ট তিরিক্ষি হয়ে আছে। রাগে তার শরীর বারবার ঘামছে৷ সোফায় বসে সে ডেস্কে হাত দিয়ে দেখে নিউজ পেপারটা নেই৷ সে কি, নিউজ পেপার নেই কেন?ইজহার চেঁচিয়ে কাজের লোককে ডাকতে লাগলো। কাজের লোক ভয়ে ভয়ে ইজহারের সামনে এসে দাঁড়ালো। 

-খবরের কাগজ কোথায়?

-এহানে রাহা আছিল সাব৷ 

-নেই এখানে৷ 

-আমি তায়লে মাজির রুমে দেহে আসি। 

-যাও৷ 

ইজহারের রাগ পড়েনি৷ সে ডেস্কের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল নিউজ পেপারটা তো এখানে ই রাখা৷ এতক্ষণ তো ছিল না৷ হুট করে কোথা থেকে আসল?ইজহারের মনে সন্দেহ হল। ঠিক তখন সোফার পেছন থেকে খসখস শব্দ শুনে সে সোফার পেছনে উঁকি দিয়ে দেখে মুহীন সোফার পেছনে গুটিয়ে বসে আছে। ইজহার রাগে কিড়মিড় করতে করতে চেঁচিয়ে উঠল

-তুমি?সোফার পেছনে কী কাজ?

মুহীনের তার করা শপথের কথা মনে হতেই দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল৷ ইজহার মুহীনের হাত টেনে ওকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে বলল

-বের হয়ে আসো৷ কুইক। 

মুহীন বের হয়ে তো আসলো। কিন্তু এক মিনিট ও না দাঁড়িয়ে এক ভোঁ-দৌড় দিয়ে বের হয়ে সোজা রাস্তায়৷ ইজহার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে রাগে তার হাত থেকে নিউজ পেপারটা ছুড়ে ফেলে নিজের রুমে চলে গেল৷ 

মন কিছুটা শান্ত হওয়ার পর খেয়াল হলো তার হাতের আংটি রক্তে লাল হয়ে আছে৷ ইজহার আৎকে উঠলো। কার রক্ত?মুহীনের নয় তো। হ্যা,মুহীনের ই তো। ইজহারের খেয়াল হলো,যখন সে মুহীনকে হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল তখন মুহীন ছুটার জন্য হাত সরাতে গিয়ে হয়ত আংটিতে লেগে কেটে গেছে৷ ইজহারের মন কেমন করে উঠল। তার চোখ ভিজে গেল। ইসরে!সে মুহীনকে সর্বদা যন্ত্রনা ই দেয়৷ এমন কেন হয় সব সময়? ইজহার বিষন্নতা নিয়ে আজ বাসা থেকে বের হয়েছে। 


মুহীন কাটা হাতে একটা টেপ লাগিয়ে ছাদের এক কোণে বসে বসে একটা বই পড়ছিল৷ কিন্তু তার পড়ায় মন বসছিল না। বারবার সে কাটা হাতটার দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে ইজহার মাহমুদ একটা দানবের চেয়ে কোন অংশে কম না৷ হিংস্র দানবের মত ব্যবহার তার। আজ বড় বাঁচা বেঁচেছে সে।যে ভাবে হায়েনার মত ফোঁসফোঁস করছিল মুহীন তো ভেবেছিল তার জীবন লীলা সাঙ্গ হবে৷ এমন রেগে থাকে কী করে একটা মানুষ৷ মুখে হাসি নেই,চোখে আনন্দ নেই যেন নির্জিব কোব মরুদ্যান৷ বড় বিচিত্র ঠেকে ইজহার মাহমুদকে মুহীনের কাছে৷ বড় বিচিত্র তার মন৷ 

মুহীন যখন বই পড়ছিল ঠিক তখন তার দুলাভাই তার সামনে এসে দাঁড়ালো। মুহীনের মনে বারবার মনে হয় এই লোকটা এত ভালো কেন?সে দুলাভাইকে দেখে আদুরে কন্ঠে বলল

-দুলাভাই,আমার বাইকের পেপারস হতে কতদিন?

ওর দুলাভাই মুচকি হেসে বলল

-এই ধর এক সেকেন্ড৷ 

বলেই পেছনের হাত থেকে পেপারগুলো বের করে দিল মুহীনকে। মুহীন আনন্দে আটখানা হয়ে দৌড়ে গিয়ে গ্যারেজ থেকে বাইক বের করে নিয়ে এলো। বাইকে চড়ে বসে স্টার্ট দিতে ই তার মনে হলো বাইক সে তেমন চালাতে পারে না। তার বন্ধু শাফিনকে বলেছিল কিন্তু সেমিস্টার ব্রেক শুরু হওয়ায় শাফিন বাড়ি চলে গেছে। মুহীন ও কাল বাড়ি যাবে৷ তার বড় ইচ্ছে ছিল বাইক দিয়ে বাড়ি যাওয়ার৷ কিন্তু এমন বাইক চালিয়ে তো আর বাড়ি যাওয়া যায় না।

সেদিন দুপুরে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল৷ মুহীন ওর আপুকে বলল, ওদের বাড়িতে যেভাবে মুরগির কিমা দিয়ে বরা বানাতো ঐভাবে বরা বানানোর জন্য৷ কিন্তু ফ্রিজে কোন মুরগি ছিল না৷ কাজের লোক ও ব্যস্ত৷ তাই মুহীন ই বাজারের জন্য বের হল৷ তখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝড়ছিল। মুহীন ছাতা মাথা দিয়ে বাজারে ঘুরে ঘুরে এটা সেটা কিনে যখন বাসায় ফিরছিল ঠিক তখন শুরু হলো বৃষ্টির তান্ডব৷ আশেপাশে কোন রিকশা ও নেই। বাজারের ব্যাগ নিয়ে মুহীন মসজিদের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আর ঠিজ তখন তার বুক কেঁপে উঠলো ইজহার মাহমুদকে দেখে৷ সে তখন মসজিদে নামাজ পড়ছিল। যোহর নামাজ তো কবে ই হয়ে গেছে৷ ইজহার মাহমুদ এখনো মসজিদে? মুহীন বারান্দা ছেড়ে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। ইজহার তখন নামাজে দাঁড়িয়ে৷ঝাপসা গ্লাসে তার মুখ দেখা যাচ্ছে৷ তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝড়ছে৷ ইজহারের চোখে পানি দেখে মুহীনের ভেতর কেঁপে উঠলো। এই মানুষটাকে সে দেখেছে স্পাতের চেয়ে ও কঠিন৷ এভাবে নামাজে দাঁড়িয়ে যে কাঁদতে পারে সেটা কখনো ভাবিনি। মুহীন বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করেনি৷ এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ই সে ভিজে ভিজে বাসায় ফিরলো। 


সারা রাত মুহীনের ঘুম হলো না৷ তার মন যে কেমন হয়ে গেছে৷ চোখ বন্ধ করলে ই ইজহার মাহমুদের চেহারা ভেসে উঠে৷ তার এই বয়সে কোন রূপসীর প্রেমে পড়ে রাত জাগার কথা ছিল অথচ সে কিনা একজন মেয়রের কথা ভেবে ভেবে ঘুম হারাম করছে।সে কাল বাড়ি যাবে তিন চারদিনের জন্য৷ তার মার হাতের পিঠা,নাড়ু,রান্না খাবে কতদিন পর অথচ সে বিষয়ে তার কোন আগ্রহী ই নেই।

রাত কয়টায় মুহীন ঘুমিয়েছে তা ঠিক বলা যায় না৷ ঘুম ভাঙলো তার আপুর ডাকে৷ মুহীন ঘুম থেকে জেগে সবার আগে যে সিদ্ধান্ত নিল সেটা হচ্ছে ইশার সাথে দেখা করা৷ তাকে তার ভাইয়ের কথাটা বলা। ইশার কাছে সেটা না বলতে পারলে যেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে৷ দ্বিতীয়ত ইশাকে নিয়ে বাড়ির সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করা৷ তাই সে ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে একবার গুণে নিল। 

তার কাছে টাকা কিছু কম আছে৷ ধার করতে হবে৷

নিচে নেমে ইশাকে ফোন করার জন্য টেলিফোন হাতে নিল।কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোনটা ধরল। কিন্তু হ্যালো বলার আগে ই মুহীন একটানা বলতে লাগলো

-হ্যালো ইশা,শুন না-আজ দুপুরে বের হবি?আমাকে কিছু কেনাকাটা করতে হবে। আর শুন,কিছু টাকা ধার দিতে হবে৷ এই দু হাজার হলে ই হবে৷ হ্যালো,শুনতে পারছিস?কথা বলছিস না কেন?কিরে...

-আমি ইশাকে জানিয়ে দিব৷ 

মুহীন টুক করে ফোনটা কেটে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল। ইজহার মাহমুদ ছিল ফোনে৷ কী অদ্ভুত ব্যাপার। লোকটা কী ভাববে?ভাববে হয়তো এভাবে ই মুহীন ইশার কাছ থেকে ধার দেনা করে চলে৷ মুহীনের বুক কাঁপতে লাগলো। 

খাবার টেবিলে ইজহার ইশাকে বলল ফোনের কথা৷ ইশা অবাক হয়ে বলল

-তোমার সাথে মুহীন কথা বলল?তা ও ফোনে?অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়নি তো?

ইজহার খাবার টেবিল থেকে উঠতে উঠতে বলল

-ড্রয়ার থেকে টাকা নিয়ে যাবি। তুর বন্ধুর টাকা ধরকার। 

-সেকি!ও তো আজ অবধি ধার করেনি। হঠাৎ টাকা দরকার?কিছু কি হয়েছে?কত টাকা লাগবে?কত লাখ?

ইজহার খানিক মুচকি হেসে বলল

-দুই হাজার। 

-সেকি!মাত্র দুই হাজারের জন্য ওকে ফোন করতে হলো৷ বড় অদ্ভুত!


কেনাকাটার ফাঁকে ইশা মুহীনকে ইজহার সম্পর্কে অনেক কিছু বলছিল৷ কীভাবে তার হাসিখুশি ভাইটা বাবার মৃত্যুর পর নির্জিব হয়ে গেছে৷ সারাক্ষণ হেসে বেড়ানো ছেলেটা কেন ই বা এমন রাগি চেহারা নিয়ে ঘুরে৷ মুহীন বারবার ভাবছিল মসজিদের কথাটা ইশাকে বলবে,কিন্তু কীভাবে বলবে তা ভেবে না পেয়ে আর বলল না কিছু৷ 

শপিং থেকে ফেরার পথে রিকশার জন্য দাঁড়িয়েছিল। ঠিক তখন ই ইজহার তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটা থামিয়ে জানালার গ্লাস সরিয়ে চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে বলল

-উঠ,গাড়িতে উঠ। 

ইশা ভূত দেখার মত চমকে উঠে বলল

-আরে ভাইয়া!তুমি? তুমি কোথা থেকে?

মুহীনের বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেছে। সে যে কিছু বলবে তার উপায় নেই। ইশার দেখাদেখি সে ও গাড়িতে উঠে বসল। খানিক দূর যাওয়ার পর সে ইশাকে বলল

-আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিবি কিন্তু। 

ইশা ওর ভাইকে বলল

-ভাইয়া, মুহীনকে ওদের বাসার সামনে নামিয়ে দিও তো৷ 

-না। ওকে আম্মু বলছে আমাদের বাসায় যেতে৷ 

-সে কি!আমি কিছু বলেনি তো আমাকে। 

ইজহার আর কিছু বলেনি৷ সোজা বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো। 

মুহীন ইশার মাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে সোফায় বসল। তার ঠিক পাশে ইজহার বসে আছে। মুহীন শুকনো আমসত্ত্বের মত চেহারাটা করে রেখেছে। ইজহার বারবার মুহীনের দিকে তাকাচ্ছিল৷ মুহীন সেটা লক্ষ্য করছিল ঠিক ই কিন্তু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছিল না৷ ইশা দৌড়ে এসে বলল

-মুহীন,তুই আজ কখন বাড়ি যাবি?

-বিকেলে। 

-কাল যা না প্লিজ। আমরা সবাই আজ এমপির বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে যাব৷ তুকে যেতে বলছে আম্মু। 

-আমি কেন যাব?

-আম্মু বলেছে তাই। 

ঠিক তখন ইশার মা এসে ঢুকলো

-হ্যা বাবা তুমি চল৷ তুমি গেলে আমার ভাল লাগবে৷ তুমি তো আমার পরিবার ই। 

-কিন্তু আন্টি,আমার বাসায় আজ যেতে ই হবে৷ 

-তা যেয়ো,ইজহার ওর গাড়ি করে দিয়ে আসবে তোমাকে৷ আজ গেলে ই তো হলো। 

মুহীন একবার ইজহারের দিকে তাকালো। ইজহার টিভির দিকে তাকিয়ে খবর শোনায় ব্যস্ত।

মুহীন কী বলবে ভেবে না থেকে চুপ করে ছিল৷ ইশা দৌড়ে ওর রুম থেকে প্যান্ট শার্ট এর ব্যাগ এনে বলল

-যা,উপরে গিয়ে রেডি হয়ে নে৷ এটা তুর জন্য আম্মু আনিয়েছে৷ 

-আহা!আমার ত এত কাপড় আছে৷ তারপরে ও আবার কেন?

-মার খেতে না চায়লে নিয়ে নে। দ্রুত রেডি হ গিয়ে। 

মুহীন ইতস্ততবোধ করছিল৷ ইজহার সেটা তাকিয়ে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল। মুহীন কী করবে বুঝতে না পেরে সোফায় বসে ভাবতে লাগলো কী করা উচিত তার। 


মুহীন কাপড় পড়ে রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করছিল। ঠিক তখন ইজহার তার রুমে এসে দাঁড়াল। মুহীন আয়নায় ইজহারকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো।ইজহার মুচকি হেসে বলল

-চিঠিতে তো বলেছিলে সুদে আসলে ফেরত দেওয়ার কথা৷ তা ফেরত দিবে তো?

-কী ফেরত চান? 

ইজহার দু পা এগিয়ে গিয়ে আকস্মিক মুহীনের গালে চুমু খেয়ে বসল। 

মুহীন কেঁপে উঠলো৷ তার সারা শরীর ঝনঝন করে উঠলো। এমনটা এর আগে কখনো হয়নি তার সাথে৷ সে নিজেকে কোনভাবে সামলে বলল

-এ কি করলেন?

-সুদে আসলে ফেরত দিও। 

বলে ই ইজহার চলে গেল। মুহীন গালে হাত দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভেতর জুড়ে অদ্ভুত ভালোলাগার পাশাপাশি এক ভয়াবহ শঙ্কা৷ কী হল এটা?এর কী মানে?

এই জিনিস সুদে আসলে কীভাবে ফেরত দিতে হয়?এর আগে তার সাথে এমন কিছু হয়নি৷ মুহীন তার গালে হাত দিয়ে নিচে নামতে নামতে এসব ই ভাবছিল। ইশাসহ বাকিরা মুহীনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। মুহীনকে গালে হাত দিয়ে নিচে নামতে দেখে জিজ্ঞেস করল

-কিরে গালে কী হল?

মুহীন অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিল

-কিস

-কী বললি?

ইশার ঝাঁকিতে মুহীনের হুশ এলো।গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল

-কিছু না। 

ইজহার গেইটের সামনে গাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। মুহীন একবার তাকে আড়চোখে দেখে নিল। তার ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ কী হচ্ছে তার সাথে?মনে হচ্ছে ভেতর ভেঙ্গে চূড়ে নতুন কোন অনুভূতির জন্ম নিচ্ছে৷ যে অনুভূতির কথা মুহীন আগে কখনো শুনেনি৷ বই পুস্তকে বা সাহিত্যে যার কথা লেখা হয়নি৷ মুহীন নিজেকে সামলে গাড়িতে গিয়ে বসল। ইজহার দরজা লাগাতে লাগাতে মুহীনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল

-ফেরত দেওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না। 

মুহীনের গলা শুকিয়ে গেল৷ সে ইশার দিকে তাকালো। ইশা বলল

-কীরে!ঘাবড়ে আছিস কেন?ইজি হয়ে বস তো। 

মুহীন ইজি হতে পারছে না৷ গাড়ি ছুটে চলল। সামনের সীটে ইজহার মাহমুদ বসে গান ছাড়লো। রবীন্দ্র সংগীত বাজছে

"""" প্রেমের দোয়ারে......

...........(চলবে)


অপ্রেমের কাব্য-৫ অপ্রেমের কাব্য-৫ Reviewed by Men's Love on October 15, 2023 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.