গল্প:অপ্রেমের কাব্য-৪
লেখক:-আরভান শান আরাফ
বিশাল বড় বাড়ি। মুহিনের এই বাড়িতে ঢুকতে ই ভয় করে৷ ওর মনে হয় ভেতরে ঢুকলে ই হারিয়ে যাবে৷ ওকে খোঁজতে মাইকিং করা লাগবে৷ মুহিন তার ব্যাগ নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বার কয়েক দোয়া দরুদ যা জানে পড়ে নিল৷ ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে৷
মুহিনের জড়তা কাটাতে ইশা ছুটে এলো। সে এসে মুহিন কে বাজারের গরুর মত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
-তুই সোজা উপরে চলে যাবি। আমি তুর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
মুহিন ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে মনে হলো সে এবার নিশ্চিত হারাবে৷ ইশা তাকে ঠিক কোন রুমে যেতে বলল সেটা বুঝতে না পেরে নাক বরাবর যে রুম পেল সেটাই ঢুকে গেল। গোছানো ছিমছাম রুম৷সে ভয় পাচ্ছে৷ এটা ইজহার মাহমুদের রুম নয় তো আবার। তার মেরুদন্ড দিয়ে একটা শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেল। ঠিক তখন ইশা এক বাটি স্যুপ নিয়ে এসে রুমে ঢুকে বলল
-বাহ!এইতো সব চিনে গেলি৷ রুম পছন্দ হয়েছে?
মুহিন মাথা নাড়লো। তার পছন্দ হয়েছে। সে বিছানায় ধপাস করে শুতে শুতে বলল
-আমি একটু ঘুমাব৷
-পরে ঘুমাস৷ আগে স্যুপটা খেয়ে নে৷
মুহিন স্যুপের বাটির দিকে তাকিয় বলল
-কী সব বানালি?এসব আমি খাই না।
ইশা চোখ পাকিয়ে বলল
-খেতে বলছি চুপচাপ খেয়ে ঘুমা।
মুহিন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বাধ্য ছেলের মত স্যুপ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
ইজহার মাহমুদের আজ মন ভালো৷ কেন ভালো সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সকালে ইশা বলেছিল মুহিন এসে কিছু দিন থাকবে। বিকেলে জায়গা নিয়ে যে ঝামেলা ছিল সেটা মিটে গেছে৷ সন্ধ্যায় খবর এলো,এমপি সাব নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করেছে। ঠিক কোন কারনটায় ইজহারের মন প্রফুল্ল সে বুঝতে পারছে না৷ পৌরসভার অফিস থেকে বের হয়ে সে সোজা চলে গেল বাজারের গদিতে৷ অনেক দিন পর সে গদিতে বসলো৷হালকা চা নাস্তা খেয়ে,গল্প গুজব করে বাড়ি ফিরতে ফিরতো রাত বারোটা৷
নিচ তলায় ইজহারের মা বসে ছিল৷ ইজহারকে আসতে দেখে তসবিহ পড়া থামিয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ইজহার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-মা,একেবারে খেয়ে উপরে উঠব৷ তুমি খেয়েছ?
ইজহারের মা কখনো ছেলেকে ফেলে রাতে খান না। মা ছেলে একসাথে বসে খাবার খান৷ কখনো কখনো ইশা ও থাকে৷ আজ ইশা নেই৷ ইজহার আর তার মা খাবার খেতে খেতে রাজনীতি বিষয়ক কথা বলছিল৷ ইজহার তার মাকে আশ্বস্ত করলো যে,সামনের বার মেয়র পদে সে ই নির্বাচিত হবে যদি এমপি সাব তাকে মনোনয়ন দেয়৷ এমপি সাবের সাথে ইজহার মাহমুদের বাবার সু-সম্পর্ক ছিল। সেই হিসেবে এমপি সাব ইজহারকে নিজের ছেলের মত ই স্নেহ করেন৷ কিন্তু ইদানীং শারমিন সুলতানার কূটচালের জন্য তাদের সম্পর্কে তিক্ততার অভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
মা ছেলের খাবার খাওয়া শেষে আরো কিছুক্ষণ গল্প করে ইজহার নিজের রুমে গেল৷ কাপড় ছেড়ে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকার আগে বাতি অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে৷ অনেক দিন পর হালকা লাগছে৷ গুনগুন করে একটা গান গায়তে গায়তে সে শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুহিনের ঘুম ভেঙ্গে গেছে৷ জ্বর ছিল,সেটা ছেড়ে দেওয়াতে ঘেমে গেছে৷ গলা শুকিয়ে আছে তার। সে লাইট জ্বালালো৷ আশেপাশে কোথাও পানি নেই৷ চোখ কচলে কোনমতে উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। সে সিড়ি ধরে ধরে নিচে নেমে পানি খেল৷ পানি খেয়ে কোনমতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।জ্বর ছাড়ার পর শরীরটা এত দুর্বল লাগে যে বলে বুঝানো যাবে না। বিছানায় শুয়ে তার মনে হলো,তার শরীর ধেবে যাচ্ছে৷ বিছানাটা যেন আরো নরম হয়ে গেছে৷ রুমে কেমন একটা ঘ্রাণ৷ বেলি ফুলের মত৷ মুহিনের মনে হলো সে অসুস্থ্য তাই হয়তো রুমটা এমন লাগছে৷ সে দ্বিধাহীনভাবে চোখ বন্ধ করল।
ইজহার গোসল শেষে বিবস্ত্র হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে বাতি জ্বালাতেই আতকে উঠলো৷
বিছানায় কম্বল জড়িয়ে একজনকে শুয়ে থাকতে দেখে সে কে কে বলে চিৎকার করে উঠল।
ইজহারের চিৎকার শুনে মুহিন লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে দেখে তার সামনে ইজহার মাহমুদ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে৷ সাত পাঁচ ভাবার আগে ই সে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে আবার বিছানায় পড়ে গেল। ইজহার দ্রুত পায়জামা আর গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইশাকে ডাক দিল। ইশা ছুটে এসে দেখে মুহিন তার ভাইয়ের রুমের বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷ ইশা কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে বলল
-ভাই,ও এই রুমে কেন?
ইজহার একটা মৃদ হাসি ওর ঠোঁটের কোণায় রেখে বলল
-ওকে ই জিজ্ঞেস কর না। পাগল
-ওর জ্ঞান ফেরাও আগে৷
ইজহার ওর মাথায় হাত দিল। নাহ জ্বর নেই। পালস চেক করল৷ সেটা ও ঠিক আছে৷ ইশা পানি এনে মুখে ছিটিয়ে দিতেই মুহিন চোখ খোলল। চোখ খোলতেই দেখে ইজহার তার দিকে ঝুঁকে আছে। সে ইশার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে বলল
-ভুলে এসে পড়েছি।
ইশা মুহিনের মাথায় হাত দিয়ে বলল
-সমস্যা নেই৷ আয়,রুমে এসে শুয়ে থাক।
ইজহার বলল
-সমস্যা নেই৷ ওর যদি এ রুমে থাকতে ইচ্ছে হয় থাকবে৷ আমি না হয় নিচে মায়ের সাথে থাকব।
মুহিন লাফ মেরে বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল
-না না৷ ইশা চল তো৷
ইজহার মুহিনের দিকে আবারো মৃদ হাসিতে তাকিয়ে বলল
-আরে নাহ৷ থেকে যেতে বল ইশা৷
মুহিন হন হন করে বের হয়ে গেল। এখন আর তার মাথা ঘুরছে না৷ এ কি আজব মানুষ!এমনিতে সারাদিন রেগে থেকে আর এখন কত খাতির!
ইশা ডান বাম কিছুই বুঝতে না পেরে মুহিনের পিছু পিছু চলে গেল।
সকালে নাশতার টেবিলে ইশা মুহিনকে টেনে নিয়ে এসে বসালো৷ ইজহার তখন চামচ দিয়ে দই চিড়া মিশিয়ে খাচ্ছিল৷ মুহিনকে আসতে দেখে আড় চোখে একবার তাকালো। খাবার টেবিলে কেউ কোন কথা বলেনি। মুহিন খেতে খেতে ইজহারের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। ইজহার একটা ছাই রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে৷ তার বড় বড় চোখ,ঘন চাপ দাড়ি, পেশিবহুল শরীর দেখলেই মুহীনের শরীর ভয়ে কেঁপে উঠে৷ তার মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন তাকে পুলিশে দিয়েছিল৷মুহীনের মনে হলো বাসায় ইজহার মাহমুদ যত কোমল,শান্ত বাহিরে ততটাই কঠিন৷
মুহীনকে মিনিট পাঁচেক ধরে একটা পরোটা খেতে দেখে ইশার মা বলল
-সে কি বাবা!তুমি পরোটা ই খেয়ে যাচ্ছো৷ একটু পায়েস খাও।
মুহীন পায়েসের চামচ মুখে দিয়ে ইজহার মাহমুদের দিকে তাকালো৷ সে কি! ইজহার মাহমুদ তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ পায়েসের চামচ মুখে থাকতে ই তার হিচকি উঠে গেল। ইশা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পানি খেতে খেতে বলল কিন্তু মুহীন পানি না খেয়ে ই রুমে চলে গেল৷ ইশা মুহীনের পেছনে পানির গ্লাস নিয়ে ছুটল আর তাদের পেছনে ইশার মা৷ ইজহার মাহমুদ নিজের মত করে দই চিড়া খেতে লাগলো।
কলেজ থেকে ইশা আর মুহিন এক সাথে ই ফিরলো রিকশা করে। কাল থেকে সেমিস্টার ফাইনাল। মুহীনের মাথায় ঘুরছে। ইজহার মাহমুদ বাড়িতে থাকলে তার পড়াশোনার ভরাডুবি হবে৷ ইজহার মাহমুদকে দেখলেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। বুকের ভেতরটা কেমন ধুকধুক করে৷ মনে হয় সে কোন বিপদে পড়েছে যার কোন কূল কিনারা নেই৷ তারুপরে সেদিন ইজহার মাহমুদকে ঐ অবস্থায় দেখার পর থেকে তার যে কী হয়েছে। গতকাল রাতে সে একি রকম স্বপ্ন দেখলো। এর আগে মুহীন কখনো কোন মানুষকে এই অবস্থায় দেখেনি। তার ১৮/১৯ বছর বয়সে যৌনতার হাতে খড়ি বলতে খুব ১২/১৩ বছর বয়সে পাড়াত এক কাকীর বুকে হাত রাখা।সেটা ও কাকীর ইচ্ছেতে। কাকী হয়তো আরো অনেক কিছু ই চায়তো কিন্তু মুহীন সেদিন ভয়ে দৌড়ে চলে আসে। এরপর আর কোন দিন সেই কাকীর কাছে যায়নি। ঐদিন রাতে ইজহার মাহমুদকে নগ্ন অবস্থায় দেখার পর তার মনে হলো,সকল মানুষ ই হয়তো এমন সুন্দর৷ কিন্তু মুহীনের টা তো এত বড় না৷ আর তার জিনিসটা এতটা কালো না। মুহীনের শরীরে বা বুকে কোন লোম নেই কিন্তু ইজহার মাহমুদের শরীরে কালো কালো লোম। তার সুঠাম শরীরে সেটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।মুহীন নিজে ও পুরুষ। কিন্তু ঐ রাতের পর থেকে তার কাছে নিজেকে কেমন যেন অচেনা লাগছিল৷ একজন ছেলে হয়ে আরেক জন ছেলের শরীর এভাবে তার ভালো লাগতে যাবে কেন?এমন তো আগে হয়নি।
ইজহার মাহমুদ নিচে বসে বসে টিভি দেখছিল৷ ইশা তার ভাইকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল
-সে কি ভাইয়া!আজ বাড়িতে?সূর্য কোন দিকে উঠলো?
মুহীন দেখলো ইজহার সোফায় বসে ইংরেজি নিউজ দেখছে।তার বুকের ধুকধুকানি আরো বেড়ে গেল৷ তার মনে হলো তার বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে যাবে। সে ইশার দিকে তাকালো।তার মনে হলো,ইশা সব বুঝতে পারছে। সে একহাতে তার বুক চেপে ধরে একবার ইশা আরেকবার ইজহার মাহমুদের দিকে তাকালো। তার ভেতরের ধুকধুকানি আরো বেড়ে গেল৷
ইজহার টিভির স্কিন থেকে চোখ সরিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে বলল
-সূর্য কোন দিকে উঠেছে সেটা সূর্যকে ই জিজ্ঞেস কর গিয়ে৷ আজ কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না৷ বিকেলে আমার কিছু ছেলে পুলে আসবে তাদের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করিস৷
-তা তো করব ই। কিন্তু ভাইয়া,আমি কিন্তু আজ রুম থেকে বের হব না৷ কাল থেকে এক্সাম৷
ইজহার আর কিছু বলেনি৷ সে নিজের রুমে চলে গেল।
মুহীন খানিক সোফায় বসলো ইশার সাথে তারপর সে ও চলে গেল। তার আজ প্রচুর পড়তে হবে।
দুপুর থেকে মুহীন পড়ার টেবিলে। তার মাথা ভারী হয়ে আছে৷ এক কাপ চা হলে ভালো হয়।চায়ের জন্য নিচে যেতে তার ভয় লাগে৷ নিচে ইজহার মাহমুদ তার ছেলে পুলে নিয়ে মিটিং বসিয়েছে৷ এখন নিচে গেলে আবার ইজহার মাহমুদের দিকে তার নজর যাবে৷ বুকের ধুকধুকানি বেড়ে যাবে৷ তখন আর তার পড়া হবে না৷ এসব ভাবতে ভাবতে মুহীন পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিল না, ঠিক তখন কাজের লোক চা নিয়ে এলো। মুহীন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল
-কে পাঠিয়েছে?
বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল
-মেয়র সাব।
মুহীনের সারা শরীর ঝনঝন করে উঠলো। এই মানুষটা তার জন্য চা পাঠাবে?এটা ও সম্ভব?
মুহীন চায়ে চুমুক দিতে ই মনটা ভরে গেল৷ আহা! দারুণ স্বাদের চা৷ তাদের গ্রামের মোড়ে তৈয়ব আলী এমন চা বানাতো৷ সে অনেক কাল আগের কথা। প্রায় সাইকেল নিয়ে চা খেতে যেত৷ আজ অনেক দিন পর সেই চায়ের স্বাদ পেল সে৷ এ বাড়িতে এর আগে ও সে চা খেয়েছে৷ কিন্তু আজকের চাটা অন্য রকম স্বাদ।চুমুকেই ক্লান্তি বিলীন হয়ে গেল। মুহীন চা শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ইজহার মাহমুদ ফুল গাছে পানি দিচ্ছে৷ মুহীন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দেখলো৷ তারমনে হলো, মানুষটা মন্দ না৷ এত সুন্দর যার চোখ,এত যত্ন যার পরিবারের প্রতি,প্রকৃতির প্রতি, চারপাশের মানুষের জন্য। সে কেন তার সাথে এত কঠিন ব্যবহার করে?মুহীনের বুক ধুক ধুক করে উঠল৷ সে বুকে হাত দিয়ে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে গেল৷
রাতে ইজহার খাবার টেবিলে মুহিনকে দেখতে না পেয়ে বলল
-কিরে,অতিথি কোথায়?
-ও খাবে না।
-কেন?
-ও তো আমার মত বাজে স্টুডেন্ট না,সে নাওয়া খাওয়া ভুলে ই পড়ে।
ইজহার কিছু বলল না৷ খাবার শেষে উঠে যাওয়ার সময় বলল
-কাল আমি নিয়ে যাব তুদের গাড়ি করে৷ কয়টায় যাবি?
-নয়টায় বের হব।
ইজহারের কী যে হলো সে বুঝে পাচ্ছে না। একটা ১৯/২০ বছরের ছেলের প্রতি সে কেন যে এত টান অনুভব করছে? তার ইচ্ছে হচ্ছে তার এই বিছানায় মুহিনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে৷ সেটা না হোক,মন চাচ্ছে মুহীনকে প্রাণ ভরে দেখতে। তার সদ্য গজানো দাড়িগুলো,আয়তলোচন চোখ, চঞ্চল চেহারা আর ঠোটের কোণায় লেগে থাকা মৃদ হাসিটা তাকে উন্মাদ করে দিচ্ছে । পাশাপাশি একটা ভয় তার মেরুদন্ড কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মিছে মিছে কাছে পাওয়ার বাসনা আবার না পাওয়ার যন্ত্রনায় ডুবিয়ে দিবে না তো?
ইজহারের ঘুম হলো না সারা রাত্রি। পাশের রুমে মুহীন৷ মুহীনের প্রতি তার এই আসক্তি নিয়ে সে ঘুমাতে পারেনি৷ সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন নির্ঘুম রাতের কারনে চোখ অগ্নিবর্ণ হয়ে আছে। ইশা তার ভাইকে এক নজর দেখে ই আৎকে উঠে বলল
-সে কি ভাই!রাতে ঘুম হয়নি নাকি?
ইজহার ইতস্ততবোধ নিয়ে বলল
-রেডি হয়ে যা৷ আমি গাড়ি নিয়ে বাহিরে আছি।
-তুমি পারবা তো ড্রাইভ করতে?
-পারব৷ তুকে ভাবতে হবে না।
মুহীন আর ইশা একসাথে ই বের হলো। ইজহার তখন লাল রঙের গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। মুহীন মনে মনে আল্লাহকে ডেকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে ইজহারের দিকে তাকালো। ইজহার আজ কালো সুট পড়েছে। চোখে কালো গগলস। তাকে বড় কোন প্রাইভেট কোম্পানির কর্মকর্তার মত লাগছে। মুহীনের মনে পড়ল সেই রাতের কথা যেদিন ইজহার তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল। ইজহারের কারনে তাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে,পরিবার ছাড়তে হয়েছে। আজ তার গাড়ি করে ই তাকে পরিক্ষা দিতে যেতে হচ্ছে।
সারাপথ ইজহার কোন কথা বলেনি৷ যা বলার ইশা বলেছে। মুহীন শুধু ইশার কথায় মাথা নেড়েছে। ইজহারের ইচ্ছে করছিল মুহীন কে জিজ্ঞেস করতে,সে কেন তাকে এত ভয় পায়৷ কেন সে ইজহারের সামনে এলে ফ্যাকাশে হয়ে বুক চেপে ধরে। মানুষ খুন করার রেকর্ড তো তার নেই। তবে কেন এত ভয়?
গাড়ি থেকে নামার সময় ইজহার খেয়াল করল মুহীন চিন্তিত। সে গাড়ির জানালায় মুখ বাড়িয়ে বলল
-কী ব্যপার, ভয় পাচ্ছ নাকি?
মুহীন ইজহারের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঢ্যাবঢ্যাব করে ইজহারের দিকে খানিক তাকিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। ইজহার তার চোখ থেকে গগলসটা খোলে মুহীনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল
- ছোটলোক
পরক্ষণেই তার মন বিষাদে ছেঁয়ে গেল। সে কেন তাকে গালি দিল?সে তো কোন দোষ করেনি৷ কী হচ্ছে তার সাথে?
ইজজার ছাদের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল।সারা রাত্রি ঘুম হয়নি তাই মাথা ঝিমঝিম করছে৷ আজ পৌরসভাতে যাওয়া হয়নি, সামনের সপ্তাহ এমপি সাবের বাসায় দাওয়াত তার পরিবারের। কোন খেলা এমপি সাব খেলে সেটা নিয়ে সে চিন্তিত। ছাদের পূর্বদিকে অপরাজিতা গাছে প্রচুর ফুল ফোটেছে৷ নীলফুলে ছাদের ঐদিকটা ছেঁয়ে আছে৷ ইজহারের মন ভরে গেল এতগুলো ফুল দেখে৷ আচ্ছা,মুহীনের ও কি ফুল পছন্দ? ইজহার মনে মনে প্রশ্ন করলো। ইজহার অপরাজিতা গাছের কিছু পাতা আর মুচড়ে যাওয়া ফুল ছিড়ে ছাদের নিচে ফালালো। সে খেয়াল করেনি যে নিচে মুহীন দাঁড়িয়ে ছিল। ফুল আর পাতা গিয়ে মুহীনের মাথায় পড়ল। মুহীন রেগে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে ইজহার।ইজহার যখন খেয়াল করলো, মুহীন তার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকিয়ে আছে তখন তার ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। এত সুন্দর চোখ ছেলের৷ ইজহার মুগ্ধ আর বিব্রত চোখে তাকিয়ে থেকে নিজেকে আড়াল করতে অন্য দিকে সরে গেল।
মুহীন বিষয়টা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ায়নি৷
মুহীন তখন পড়ার টেবিলে ছিল। সে যখন মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল ঠিক তখন ইজহার দুই কাপ কফি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো৷ মুহীন ইজহারের রুমে ঢুকা খেয়াল করেনি৷ ইজহার মুহীনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলল
-কফি খেলে মনে হয় আরো জোরে চেঁচিয়ে পড়া যায়।
মুহীনের বুক কেঁপে উঠলো। সে ইজহারের দিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠে বলল
-আপনি?
-হ্যা,কফি নিয়ে এলাম। কোথায় রাখব এটা?
-আমি কফি খাই না৷
-কেন?
-জানি না।
এত শখ করে ইজহার কফি বানিয়ে নিয়ে এলো আর মুহীন সেটা খাবে না বলছে। ইজহারের মাথা গরম হয়ে গেল৷ রাগে তার ভেতর আগুনের মত জ্বলতে লাগলো। সে কী করবে বুঝতে না পেরে কফি মগ দেয়ালে ছুড়ে মেরে বের হয়ে গেল। মুহীন ঘটনা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। শব্দ শুনে ইশা দৌড়ে এলো৷ এসে এই অবস্থা দেখে মুহীনের কাছে জানতে চায়ল কী হয়েছে। মুহীন ইশাকে সব বলার পর ইশা মুহীনকে বুঝালো যে,তার ভাইয়ের রাগ বেশি৷ সে না শুনতে পারে না। মুহীন বলল
-আমি কফি খাই না সেটা ও কি 'হ্যা' বলতে হবে?
-রেখে দিতি।
-পারব না৷
ইশা মুখ ভার করে চলে গেল৷ তার মনে হলো,ইজহার আর মুহীন এক জাতের মানুষ৷ এই জন্য ই তাদের মধ্যে এত ঝগড়া।
ইজহার বাড়ি ফিরলো রাত দেড়টায়৷ পৌরসভায় মিটিং ছিল। খেয়ে ধেয়ে উপরে উঠতে ই খেয়াল করলো মুহীনের রুমে বাতি জ্বলছে৷ ইজহার মনে মনে প্রশ্ন করল
-এখনো ঘুমায়নি নাকি?এত রাত জেগে পড়ার কী আছে?
একবার গিয়ে দেখি আসি তো।
ইজহার দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে ই দেখল মুহীন পড়ার টেবিলে ই ঘুমিয়ে আছে৷ ইজহার রুমে ঢুকলো, রুমের আলো নেভানো। বাহিরের মৃদ আলোয় রুম আলোকিত হয়ে আছে।একটা নীলাভ আলো এসে মুহীনের চেহারায় পড়েছে। সে তার হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে৷ ইজহারের মন কোমল হয়ে গেল৷ এত নিষ্পাপ একটা চেহারা৷ এত মায়া তার চেহারাটায়৷ ইজহার অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থেকে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে মুহীনের গালে চুমু খেয়ে বের হয়ে এল।বের হয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করলো
মুহীন সেই চুমু কে মশার কামড় ভেবে গাল চুলকিয়ে আবার নিজের মত ঘুমিয়ে পড়েছে৷
ইজহারের মন খুশিতে গেল। অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে তার ভেতরে জুড়ে৷ তার সারা শরীরের অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে গেল। তার এই মুহুর্তে ভয়াবহ কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে৷ একদম ভয়াবহ কিছু।
সকালে নাস্তার টেবিলে ইজহার খেয়াল করলো মুহীন নিচে নামেনি নাস্তার জন্য। ইজহার ইশাকে জিজ্ঞেস করল
-কিরে,তুর গেস্ট কোথায়?
-সে নাকি খাবে না।
-না খেয়ে ই আজ পরিক্ষা দিবে?
-আজ পরিক্ষা নেই ভাইয়া।
-পরিক্ষা নেই বুঝলাম৷ তাই বলে কি,না খেয়ে থাকবে?
-ও এমন ই।
ইজহার কাজের লোককে একটা প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে আসতে বলল। কাজের লোক মতি মিয়া একটা প্লেটে একটা স্যান্ডউইচ, একটা কলা,এক বাটি হালুয়া এনে ইজহারের সামনে রাখলো। ইজহার সেই প্লেট নিয়ে সোজা মুহীনের রুমে চলে গেল৷ ইজহার কে রুমে ঢুকতে দেখে ই মুহীন মনে মনে বার কয়েক ইশ্বরের নাম জপে নিল। ভয়ে তার বুক কাঁপছিল। না জানি আবার কোন ঝগড়া বেঁধে যায়৷ ইজহার খাবারের প্লেটটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল
- খাবার দিয়ে যাচ্ছি৷ খেয়ে নিও। না খেয়ে পড়াশোনা করার কী দরকার।
মুহীন একবার ইজহারের দিকে তাকালো। তার মনে হলো এই লোকটা খুব ভালো মনের৷ হয়তো বাহিরে একটু কঠিন কিন্তু ভেতরে কোমল। ইজহার দাঁড়ালো না। খাবারের প্লেটটা রেখে বের হয়ে গেল। মুহীন কিছুক্ষণ বাহিরের দিকে তাকিয়ে থেকে হালুয়ার বাটিটা হাতে নিলো।
এ কয়টা দিন ইজহার নিজেকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু সে ব্যর্থ৷ তার মন তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে৷ সে তার চেয়ে বয়সে ছোট এক ছেলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে৷ রার বিরাতে তার মন ছটফট করে তাকে কাছে পাওয়ার জন্য৷ নানান বাহানায় তার সাথে যখন তখন কথা বলতে ইচ্ছে করে৷ ইচ্ছে করে তাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে৷ কিন্তু,এসব কি আদৌ সম্ভব?ইজহারের কেন যে মনে হয় মুহীন তাকে ঘৃণা করে৷ তার প্রতি তার কোন টান বা আবেগ কাজ করে না। কারন যতবার ই তাদের দেখা হয়েছে ততবার ই মুহীন হয় জড়তায় আড়ষ্ট হয়ে ছিল না হয়,রাগ আর ঘৃণায় কাছে ঘেঁষেনি। সেদিন পরিক্ষা শেষে ইজহার অনেক ঝামেলা করে কলেজে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল ইশা আর মুহীনকে আনার জন্য৷ ইশা গাড়ি করে আসতে রাজি ছিল কিন্তু মুহীন কড়া,ভাষায় মানা করে দিল। সে বলল সে রিকশায় যাবে। গাড়িতে তার দম বন্ধ লাগে৷ ইজহার কিছু বলেনি৷ খালি গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিল। রাগে তার কান্না পাচ্ছিলো৷ তার মনে হলো,মুহীন সব সময় ই তাকে অবহেলা করে৷ সে যত নরম হতে যায় মুহীন তত শক্ত হয়ে থাকে৷ নিজের প্রতি ইজহারের খুব রাগ হয়৷ এমন কেন হচ্ছে তার সাথে সে বুঝে পাচ্ছে না।
সেদিন মুহীন খুব ভোরে জেগে গিয়েছিল। রুম থেকে বের হতে ই দেখে ইজহার মাহমুদের রুমের দরজা খোলা। সে দরজার আড়াল থেকে রুমের ভেতর তাকালো। ইজহার বাচ্চাদের মত হাত পা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে৷ তার হয়ত শীত লাগছিল৷ রুমে এসে চলছে। মুহীন কী মনে করে যেন রুমে ঢুকে পায়ের নিচের কম্বলটা টেনে ইজহারের শরীরে দিয়ে দিল৷ ফেরার পূর্বে মুহীন একবার ইজহারের দিকে তাকালো। একজন তেজি,রাগি পুরুষ মানুষকে ও যে ঘুমের মাঝে শিশুদের মত লাগে সেটা দেখে সে অবাক হলো।
মুহীন নিজের রুমে এসে পড়ার টেবিলে বসলো। আজ এ বাড়িতে তার শেষ দিন৷ আজ বিকেলে তার আপু,দুলাভাই চলে আসলে সে চলে যাবে৷ গত এক সপ্তাহ ধরে সে এই বাড়িতে পড়ে আছে৷ এর অধিক থাকলে সে দম বন্ধ হয়ে মারা পড়বে। তবে এই বাড়িতে থেকে সে একটা বিষয় খুব ভাল বুঝেছে,ইজহার মাহমুদ মানুষটা মন্দ না৷ হয়তো রাগ একটু বেশি, তবে মানুষ অসাধারণ। পরিবারের প্রতি যত্নশীল। মানুষের প্রতি মানবিক। খাবার টেবিলে মুহিন ভেবেছিল সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিবে পরক্ষণে কী ভেবে যেন চুপ হয়ে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার দিকে ইজহার বাসায় ফিরলো।ক্লান্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ সবার আগে গোসল করে নিল৷ ইজহারের মা খাবার টেবিলে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে৷ ইজহার খাবার টেবিলে কোন কথা বলেনি৷ চুপচাপ খেয়ে উঠে যাচ্ছিল ঠিক তখন তার মা বলল
-ইজহার শুন, বস খানিক
ইজহার না বসে ই বলল
-কিছু বলবে মা?
-মুহিন চলে গেছে৷
-আচ্ছা৷
ইজহার আর কিছু বলেনি। তার ভেতরটা কেমন যেন জ্বালা করছিল। গেল এক সপ্তাহ মুহিন ছিল৷ ইজহারের ভেতরে সর্বদা একটা আনন্দ কাজ করত। পৌরসভা থেকে দ্রুত চলে আসতো। তারমনে হতো বাসায় কেউ একজন আছে যাকে দেখলে তার মন ভালো হয়ে যায়৷ আজ সেই মানুষটা তাকে না বলে ই চলে গেল৷ ইজহার কি এতটা ই খারাপ?এত অবহেলা কেন করে মুহীন তাকে?তার বুকে অশান্তি শুরু হয়ে গেল৷ মনে হলো কী যেন নেই।
রুমে ফিরে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷ হঠাৎ করে চোখ গেল ড্রেসিং টেবিলের দিকে। সেখানে একটা পাথরের নিচে কাগজ রাখা৷ ইজহার লাফ দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা কাগজটা হাতে নিল। এক পৃষ্ঠা ভরে কী সব লিখা৷ মনে হয় কোন চিঠি৷ কিন্তু, ইজহারের রুমে চিঠি কে রাখবে?কার জন্য রাখবে?ইজহার কি চিঠিটা পড়বে?যদি অন্য জনের হয়?
.........(চলবে..)
No comments: