Onlyfan Premium Videos

গল্প:প্রেমালিঙ্গণ


 গল্প:-প্রেমালিঙ্গণ

লেখক:-আরভান শান আরাফ



আমরা যেদিন মারয়ংতং গিয়ে পৌঁছালাম সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি। খাড়া পাহাড় বেয়ে চূড়ায় উঠতে গিয়ে কতবার যে পা পিছলে পড়েছি তার হিসেব নেই। হিসেব নেই বললে ভুল হবে,আমার বন্ধু একান্ত হিসেব করে বলেছিল আমি বাইশ বার আছাড় খেয়ে পড়েছিলাম৷ শেষবার তো মরতে মরতে বেঁচেছি৷ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সাঙ্গু নদী আর মেঘের অপার সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেল। পায়ের ব্যথা,হাতের কাটা ছেড়া সব ভুলে গিয়ে মনে হলো,এখানে না এলে জীবন বৃথা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। 

আমরা তিন দিন ক্যাম্পিং করেছিলাম। শেষদিন খুব ভোরে তাবু থেকে বের হয়ে বৌদ্ধ মন্দিরের পাশে অশ্বথ গাছের নিচে বসে মেঘের খেলা দেখছিলাম। ঠিক তখন খেয়াল হলো আমার থেকে দূরে একজন বসে আছে৷ আমি ধীর পায়ে হেঁটে গেলাম। ভাবলাম একা বসে না থেকে কিছু কথা বলি। আমার পায়ের শব্দ শুনে ভদ্রলোক ফিরে তাকালো। ত্রিশ বত্রিশ বছরের একজন লোক৷ চোখে মুখে উপচে পড়া বিষণ্ণতা। আমি মেঘের অপার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ চোখে বললাম

-কত সুন্দর তাই না?

ভদ্রলোক কিছু বলেনি৷ কিন্তু আমার মনে হলো তিনি মাথা নেড়েছেন। আমি আর কোন কথা না বলে মেঘে ভেজা দূর্বা ঘাসে বসে পড়লাম। একটু শীত শীত লাগছিল। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না। 

মিনিট দুয়েক বাদে ভদ্রলোক প্লাস্টিকের চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল

-নেন,চা খান৷

আমি চায়ের কাপ নিতে নিতে বললাম

-চা কোথায় পেলেন?

সে চোখের ইশারায় তার পাশে রাখা ফ্লাস্ক দেখালো৷ আমরা চা খেতে খেতে কথা বললাম৷ অনেক কথা। 

সে আর তার দুজন বন্ধু এসেছেন। তারা ঘুমাচ্ছে। তারা আরো দুদিন থাকবে। কাল রাতে এসেছেন৷ 

ধীরে ধীরে সূর্য উঠলো। আমাদের আশে পাশে আরো অনেক লোক এলো৷ আমার বন্ধুরা এলো৷ আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। দুপুর গড়ার আগে আগে আমরা নিচে নেমে এলাম। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে আলীকদমের পাহাড় দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আরো একদিন পাড় হলো। 

জীবনে কত মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয়৷ কথা হয়৷ কেউ কেউ মনে থাকে, কেউ কেউ দিন গননার আগে ই স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়৷ কিন্তু আমার যে কী হয়েছিল৷ মারয়ংতং থেকে ফেরার বহুদিন পর্যন্ত আমার তার কথা মনে ছিল। 

 

ভালো সিজিপিএ নিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হলাম৷ বিসিএস এর প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি অন্য জবের জন্য ও চেষ্টা করছি। আমার ডক্টর বাবা আমার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন৷ তার বড় ছেলে ডক্টর,ছোট ছেলে মেডিক্যালে পড়ছে৷ আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাথম্যাটিকস পড়েছি সেটা তার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করে না৷ তার ধারনা,ইউনিভার্সিটিগুলো মূর্খ তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে৷ তার একমাত্র পছন্দ ডক্টর৷ সে হয়তো আমার কাছ থেকে সেটাই আশা করছিল কিন্তু আমি উলটো পথে হাঁঠলাম। ঢা.বি তে পড়ার স্বপ্নটা পূরণ করলাম৷ অনেক কথা শুনতে হয়েছিল এবং এখনো শুনি। আমার ভাইয়া,আপু,তার স্বামী সবাই নিজেদের জীবনে সফল৷ বর্তমানে আমি ই বেকার৷ জব হচ্ছে না। বিসিএস এর ভাইবা দিয়ে বসে আছি। চূড়ান্ত রকম খারাপ হয়েছে ভাইবা। সেটা নিয়ে আমার মধ্যে কোন আক্ষেপ দেখতে না পেয়ে আমার বাবা মা দুজন ই আমার উপর বিরক্ত৷ 


সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা৷ পকেটে ছিল মাত্র পঁচিশ টাকা। সেটা এক ভিখারীকে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। পেটের খিদায় প্রাণ যায় যায়৷ বাসায় ঢুকে দেখি সারা বাসা খালি৷ কেউ নেই৷ আমি মনসুর কাকা কে ডাকলাম। সে ও নেই৷ বাহিরে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করায় বলল সবাই কক্সবাজার গেছে, ফ্যামেলি ট্যুরে। 

দারোয়ান জিজ্ঞেস করল

-আপনি যান নি কেন?

আমি কিছু বলিনি৷ ফ্রিজ খোলে যা পেলাম তা ই গরম করে খেয়ে নিলাম। বাসার ফোন থেকে, ফোন করলাম আম্মুর কাছে। আম্মু ধরেনি৷ হয়তো সমুদ্র বিলাসে ব্যস্ত। 


পুরান ঢাকায় আমার এক বন্ধু আছে ইউসুফ খাঁ নামের। সেদিন ও ফোন করে বলল

-বন্ধু একবার রাজু ভাস্করের সামনে আয়তো৷ প্রতিবাদ সমাবেশ আছে৷ 

আমি প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদান করতে গিয়ে গ্রেফতার হলাম। শুধু আমি না৷ আমার সাথে ইউসুফ খাঁ ও। গাড়িতে বসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম

-কিরে,কিসের প্রতিবাদ ছিল?

সে বলল

-লিভিং এর বৈধতা দেওয়ার জন্য। 

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে যত প্রকার গালি দেওয়া যায় তা দিলাম। 

 ওর এই আজগুবি প্রতিবাদের জন্য আর কতবার যে বিপদে পড়ব আল্লাহ পাক জানেন৷ 


আমাদের নিয়ে হাজতে আটকে রাখলো৷ আমরা দশ বারোজন। সবাই পরিচিত না৷ আমাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধলোক ও আছে৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম

-কাকা মিয়া আপনার লিভিং এর দরকার পড়ল কেন?

বৃদ্ধ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল

-বাবারে আমারে একটা পুটলি দিয়ে বলল লাইনে দাঁড়াতে৷ 

আমি পুটলিটা হাতে নিয়ে দেখি গাঁজার পুটলি। মনে মনে আবারো ইউসুফ খাঁ কে গালি দিলাম। 

বিকেলের মধ্যে অনেকে ই ছাড়া পড়ে গেল৷ সন্ধ্যায় ইউসুফ খা ও ছাড়া পেল৷ হাজতে আছি আমি আর গাঁজা সেবনকারী ভদ্রলোক। সে হাজতের এক কোণায় বসে গাঁজা খেয়ে ঝিমুচ্ছে৷ খিদায় আমার মাথায় ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বড় বাঁচা বেঁচেছি যে আব্বু আম্মু কক্সবাজার। না হয় আজ আমার রফাদফা হয়ে যেত৷ এক বস্ত্রে সন্নাস দিয়ে দিত আমাকে৷ 

হাতে গড়ি নেই। সময় দেখতে পাচ্ছি না। বৃদ্ধ লোকের হাতে ঘড়ি আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম

-চাচা মিয়া,কয়টা বাজে?

বৃদ্ধ উদভ্রান্তের মত আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-জীবনের বারোটা বাজে৷ 

পাগলকে ঘেঁটে লাভ নেই৷ তাই সময়ের হিসেব বাদ দিয়ে জীবনের হিসেব করতে লাগলাম। 

তন্দ্রায় চোখ লেগে গিয়েছিল। ঠিক তখন এক কন্সটেবল এসে বলল

-এই, বের হন। মামলা হবে। 

আমি দরজা দিয়ে বের হয়ে বললাম

-কোথায় যেতে হবে? 

- এসপি স্যারের রুমে। 

আমি বাধ্য ছেলের মত কনস্টেবল এর পিছু পিছু গেলাম৷ 

এসপি'র রুম ফাঁকা৷ আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ এসপি সাব একটা ফাইল মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন৷ আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বলল। আমি পাশের চেয়ারে বসলাম৷ পিপাসায় গলা শুকিয়ে আছে৷ একটু পানি হলে ভালো হত। সামনে গ্লাস আর জগ রাখা আছে৷ চাইলেই পানি খেতে পারি। সংকোচ হচ্ছে৷ ধমক টমক দিলে সমস্যা। 

এসপি সাব মুখ থেকে ফাইল সরালো। আমি তার দিকে তাকিয়ে 'থ' বনে গেলাম। আরে,এ দেখি মারয়ংতং এ ঘুরতে গিয়ে পরিচিত হওয়া লোকটা। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না৷ ওনি আমাকে দেখে মুচকি হেসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল

-তা,কী অবস্থা আপনার?নেন,পানি খান। 

আমি কিছু না বলে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে একটানে সবটুকু পানি শেষ করলাম। 

এসপি সাব আবার প্রশ্ন করলেন

-বললেন না যে,কী অবস্থা?

-কী আর অবস্থা?আসামী হয়ে জেল হাজতে রাত কাটালাম। 

-তা তো কাটাবেন ই৷ ভুল করবেন,শান্তি পাবেন না?

-শাস্তি তো দিবেন ই৷ আইন যেহেতু আছে,আইনের শাসন তো থাকবে ই। 

এসপি সাব মুচকি হেসে বললেন

-তা,হঠাৎ করে লিভিং এর জন্য আন্দোলনে নামতে হলো কেন?বিয়ে করে নিলে ই তো হয়। 

-বেকার ছেলের কাছে মেয়ে কে দিবে?

-যারা লিভিং এর জন্য মেয়ে দিবে, তাদের তো বিয়ের জন্য ও মেয়ে দেওয়ার কথা। 

আমি হাসলাম। এসপি সাব খানিক চুপ থেকে বললেন

-যার সাথে লিভিং করার জন্য এত আন্দোলন সে তো এলোনা ছাড়িয়ে নিতে। 

-তেমন কেউ নেই স্যার। 

-স্যার!বড় অসুন্দর স্বরে স্যার ডাকলেন।পুলিশদের লোকে অপছন্দ করে জানতাম তবে এতটা অপছন্দ আপনার কাছ থেকে আশা করিনি জনাব (ফাইলের দিকে তাকিয়ে নামটা দেখে ) মুহিব৷ 

আমি দেখলাম এসপি সাব আমার ফাইল ই দেখছিলেন৷ ফাইলের এক কোণায় আমার হাসি হাসি মুখ করে তুলা একটা ছবি যা গতকাল তুলা হয়েছিল। 

-পুলিশদের স্যার বলা ই সুন্দর সম্বোধন। 

-প্রজাতন্ত্রের চাকরদের স্যার বলতে নেই৷বললেন না যে, লিভিং এর আন্দোলনের হেতুটা কী ছিল। 

আমি ঘটনা সব বললাম৷ সব শুনে এসপি সাব অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে হেসে উঠলেন। আমি বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ অপূর্ব হাসি। মানুষের হাসিতে মানুষ মুগ্ধ হয় কীভাবে সেটা জানতাম না৷ আজ নিজে মুগ্ধ হয়ে বুঝলাম। 


অবশেষে মুক্ত হলাম৷ তবে এমনি এমনি না। মুচলেকা দিতে হয়েছে। বাসায় ফিরলাম বিকেলে। আজো কেউ ফিরেনি। আমি গোসল করে খেয়ে একটা ঘুম দিলাম৷ বাহিরে প্রচুর গরম,একটু বৃষ্টির খুব দরকার৷ সবার রুমে এসি কিন্তু আমার রুমে ফ্যান। ফ্যানের বাতাসে প্রায় ঘেমে ঘুম ভাঙলো। ছাদে গিয়ে দোলনায় বসব ঠিক তখন মনে হলো আমার ওয়ালেট থানা থেকে আনা হয়নি।ছাড়া পাওয়ার খুশিতে সেটা হাজতে ই রেখে এসেছে। সেটাতে অবশ্যই খুব টাকা পয়সা নেই তবে এমন একটা জিনিস আছে যা আমার হৃদয়ের খুব কাছে। 

পরের দিন সকালে নাস্তা খেতে রুম থেকে বের হয়ে দেখি বাড়ির লোকজন সবাই এসে হাজির। সবার মুখ হাসি হাসি৷ আমি নিজ থেকে ই বললাম

-কী, পর্যটকদের পর্যটন কেমন হলো?

আম্মু বাদে কেউ আমার দিকে তাকালো ই না৷ কথা বলল আম্মু

-কীরে,তুর ফোনের কী হল?এত ফোন দিলাম ঢুকলো না। 

আমার ফোন যে কবে ই বিক্রি করে বিসিএস আর ব্যাংক জবের ফী দিয়ে দিয়েছি তা বললাম না।কোন উত্তর না থাকায় একটা মেকি হাসি দিয়ে খাওয়াতে মন দিলাম৷ এখন খেয়ে বের হয়ে যেতে হবে৷ জ্ঞানীগুণী সফল ব্যক্তিবর্গ আজ সবাই এক ছাদের নিচে। তাদের এড়িয়ে যেতে হবে। ভালো হয় রাতের আগে বাসায় না ফিরলে। সমস্যা হলো,হাতে একটা পয়সা ও নেই। খালি হাতে ঢাকা শহরে সারভাইভ করা খুব মুশকিল। থানা থেকে ওয়ালেটটা আনা দরকার। হেঁটে হেঁটে থানায় যাওয়া,তা ও এই গরমে! এক কাজ করা যায়,আপুকে ধরে কিছু টাকা হাতানো যায়৷ কিন্তু আপুর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না৷ সেখানে হয়ত দুলাভাই আছেন৷ দুলাভাই মানে এক হাজার একশো প্রশ্ন। আরব্য রজনীর মত যে প্রশ্নের কোন পরিসমাপ্তি নেই। 

বাধ্য হয়ে আপুর বাসায় গেলাম। যেতে যেতে জুতা জোড়া ছিড়ে গেছে৷ ছয় মাস ও টিকেনি জুতাগুলো। তিনশ টাকায় গুলিস্তান থেকে কিনেছিলাম। বড় ঠকা ঠকেছি। 

বেল টিপতেই আপু দরজা খোলে দিলো। এক নজর আমাকে দেখে উদাসীন স্বরে বলল

-সোজা কিচেনে চলে যা। এক কাপ চা বানিয়ে আমার রুমে নিয়ে আয়। 

আমি বাধ্য ছেলের মত দু কাপ চা বানিয়ে আপুর রুমে গেলাম। আপু তার রুমে বসে খাতা দেখছিলেন। সে একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ান৷ আজ তাকে দেখাচ্ছে ক্লান্ত।আমার কাছ থেকে চায়ের কাপটা নিতে নিতে বলল

-তুকে ফোন করেছি অনেকবার। ফোন অফ৷ বাসার সবাই ট্যুরে। 

-এত ফোন কেন?কোন দরকার ছিল?

-হ্যা,তুকে একটা জব দিব৷ আমাদের ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন লেকচারার। করবি?

আমি উৎসাহিত সুরে জিজ্ঞেস করলাম

-কত দিবে?

-কী কত দিবে?

-বেতন। 

-শুরুতে পঁচিশ পাবি। 

আমি চায়ের কাপটা রেখে বললাম

-আপু,ঐ ২৫ হাজার থেকে আমাকে দু হাজার টাকা দাও তো। জুতা কিনতে হবে,চুল কাটতে হবে৷ চায়ের দোকানের ধার দিতে হবে৷ 

আপু চেয়ার থেকে উঠে তার ব্যাগ থেকে টাকা দিতে দিতে বলল

-তুই করবি না?

আমি টাকাটা গুণে দেখলাম তিন হাজার। বা!চাওয়ার চেয়ে পাওয়ার মান বড়। টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে বললাম

-শ্রেয়সী কোথায়?

-ও স্কুলে৷ তুই কি জবটা করবি না?

আমি বের হতে হতে বললাম আজ আসি আপু।তুমি জগতের সেরা বোন। 

-এই মুহিব, এই! শুনে যা। ভাই আমার শুনতো। 

আমি আর ফিরে তাকায়নি। আমি লেকচারার হওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।সেটা আপুকে বুঝানো আরেক কঠিন কর্ম। 


আপুর বাসা থেকে সোজা থানায়। গতকালের কনস্টেবল বারান্দাতেই ছিলেন৷ আমাকে দেখে অতি উৎসাহীত হয়ে বলল

-আরে ভাই,আপনি। আজ আবার কেন?

-আরেহ!আমার ওয়ালেটটা রেখে গিয়েছিলাম। 

-টাকা ছাড়া,ছেড়া ওয়ালেটটা আপনার?

-হ্যা,আমার ই। আছে কোথায় সেটা?

-এটা তো এসপি স্যারের কাছে। ওনি রুমে ই৷ যান। 

আমি গিয়ে দরজায় দাঁড়ালাম। বিনয়ের সুরে অনুমতি চাওয়াতে এসপি সাব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন

-আরে,আসুন আসুন। বসুন। 

আমি গিয়ে বসতে বসতে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম৷ এসপি সাব আমার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন

-হিমু,হয়েছেন নাকি?

-হিমু কি চায়লে ই হওয়া যায়?

-নাহ,পায়ে জুতা নেই তো। তাই ভাবলাম হয়তো হুমায়ুন আহমেদের হিমু ভর করেছে। 

আমি পায়ের দিকে তাকালাম  সত্য ই তো জুতা নেই। খেয়াল ই ছিল না যে জুতা ছাড়া বের হয়ে গিয়েছি। পথে এক জোড়া কিনে নেওয়া উচিত ছিল। আমাকে বিব্রত দেখে এসপি সাব প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন

-তা কী জন্য আসা হলো?

-আমার ওয়ালেটটা রেখে গিয়েছিলাম। 

এসপি সাব ড্রয়ার থেকে ওয়ালেটটা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

-টাকা কি কিছুই ছিল না৷ নাকি কন্সটেবলরা রেখে দিয়েছে?

আমি মুচকি হেসে বললাম

-ছিল না৷ 

এসপি সাব বিস্ময়ের সাথে বলল

- এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? 

-হ্যা। 

-প্রাক্তনের দেওয়া?

আমার ভেতর মুচড়ে উঠলো। আমি ওয়ালেট থেকে আধ  খাওয়া চুপসে যাওয়া সিগারেটের টুকরা বের করে বললাম 

-এটার জন্য।

এসপি সাব কিছু বলল না। আমি আর বসে থাকিনি। বের হয়ে আসি। আমার মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে ৷ আজ আমি খালি পায়ে ই থাকব৷ বাড়ি ফিরব না। আমার মন খুব ক্লান্ত৷ 

আমি গিয়ে রমনায় গিয়ে বসলাম। ঠিক তখন শুরু হলো বৃষ্টি৷ আমার ভেতর কাঁপিয়ে কান্না আসছে। এমন ই এক বৃষ্টির দিনে তাকে দাফন করেছিলাম৷ মৃত্যুর আগে সে শুধু আমাকে একটা কথা ই বলেছিল

-তুই কীভাবে থাকবি আমারে ছাড়া?

 জহির রায়হান নাম ছিল ওর।আমার নিশ্বাসে সে বাস করতো। সে ছিল আমার ভাই,বন্ধু,প্রেমিক৷ সুখি হওয়ার এক মাত্র কারন৷ আমার বুকে মাথা না রেখে ঘুমালে যে ঘুমাতে পারতো না৷ স্কুল জীবন থেকে যার সাথে আমার চলা। তারপর দীর্ঘ একটা জীবন জুড়ে কেবল সে ই ছিল। 

আমার ভালোবাসা দিয়ে তাকে আগলে রাখতে পারিনি। 

সেদিন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। রাস্তার ওপাশ থেকে সিগারেট হাতে আমার কাছে আসতে গিয়ে ডান বাম খেয়াল করেনি৷ চলন্ত মাইক্রোবাস তার দেহটাকে উড়িয়ে দিয়েছিল। আমি ছুটে গিয়ে পেয়েছিলাম তার নিথর দেহ,হাসপাতালে নিতে নিতে সে আর বাঁচেনি৷ আমাকে একা করে চলে গেলো। তার কোন স্মৃতি ছিল না আমার কাছে। ছিল শুধু আধ খাওয়া সিগারটটা। 

আজ অনেক দিন পর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে৷জীবন আমাকে কিছুই দেয়নি৷ একটুকু ভালোবাসা ও না৷ 


কোটাবিরোধি আন্দোলন তখন তুঙ্গে৷ গতবার জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি। এবার পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে না যে ছাড়া পাব।এবার নিজের প্রয়োজনে আন্দোলনে নামা৷ পরিচিত সবাই ই আছে৷ সারাদেশ থেকে মানুষ এসেছে। টানা তিন দিনের আন্দোলনে পুলিশের মার খেয়ে ইউসুফ খা,একান্ত,শুভ সবাই হাসপাতালে ভর্তি। আমি ও মার খেয়েছি কিন্তু ততটা না। বাসায় জায়গা দিচ্ছে না৷ থাকতে হচ্ছে বন্ধুদের সাথে। সেখানে ই খাচ্ছি৷ এর মধ্যে চতুর্থ দিনের মাথায় পুলিশ ধরলো। দ্বিতীয়বারের মত জেলে গেলাম। ছেলে যেতে না যেতে দেশের সুনাম ধন্য এডভোকেটরা জামিন নামা নিয়ে হাজির৷ ছাড়া পেতে ঘন্টা দুয়েক লাগলো৷ ভাবলাম যাওয়ার আগে এসপি সাবকে একবার দেখে যাই। 

তিনি হয়তো ভেবে ই রেখেছিলেন আমি আসব৷ আমাকে আসতে দেখে ই বলল

-আসুন মুহিব সাব। এসে বসুন। 

আমি গিয়ে চেয়ারে বসলাম। এসপি সাব জিজ্ঞেস করলেন

-তা আন্দোলনের কী খবর?কোটামুক্ত হবে?

-আশা করা যাচ্ছে। 

-সেটা হলে ই ভাল। কী খাবেন বলুন৷ 

-কিছু না৷ আপনাকে দেখতে এলাম। আপনাকে খুব বিষণ্ণ লাগছে। 

-তা অবশ্যই লাগছে৷এমন একটা বয়সে এসে পৌঁছেছি,যা চাই ত মুখ ফোটে বলার ক্ষমতা নেই আর চাইলে ই যে পাব তার ও নিশ্চিয়তা নেই৷ 

-কী চান শুনি তো। 

-আপাতত আপনার সাথে একান্তে বসে এক কাপ চা খেতে চাচ্ছি। 

আমি অবাক হলাম৷ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

-আমার সাথে?কেন?

-রোজ ই তো আপনাকে দেখি। আন্দোলনে মাইক হাতে,মোড়ের চায়ের দোকানে৷ অথচ কোন দিন জেল বাদে অন্য কোথাও আমাদের দেখাটুকু হয়নি। একবার দেখা তো হতে ই পারে৷ নাকি সম্ভব না? 

-অবশ্যই৷  আসুন একদিন৷ 

-আজ কি খুব ব্যস্ত?

-না তো৷ আমি সর্বদা ই অবসর। 

-তাহলে চলুন না আজ। 

-আচ্ছা আসুন। 

-একটু বসুন। আমি আসছি। 

এসপি সাব পুলিশের ইউনিফ্রম ছেড়ে শার্ট প্যান্ট পড়ে আসলেন৷ আমি তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম৷ মাথার ভেতর অদ্ভুত এক ভালো লাগা৷ আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তার সাথে বের হলাম। 


রিকশা করে আমরা একটা কফি শপে গিয়ে নামলাম৷কোণার একটা টেবিলে বসে চুপচাপ কফি খাচ্ছিলাম৷ কী বলব,কী বলা যায় তা ঠিক বুঝে পাচ্ছিলাম না। এসপি সাব ই কথা বলল

-আপনার মনে আছে মারয়ংতং আমাদের দেখা হয়েছিল। 

আমি মাথা নাড়লাম। এসপি সাব আবার বললেন

-আমি এক প্রকার ডিপ্রেশন দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন৷জব নিয়ে পেরাশান ছিলাম। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, বিনা অপরাধে আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বদলি করে দেওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু তোমার একটা কথা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে৷ অন্যের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে শিখিয়েছে। 

-ঠিক কী বলেছিলাম মনে নেই 

এসপি সাব আমার দিকে একটু ঝোঁকে এসে বলল

-তুমি বলেছিলে,যদি আমরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য বাঁচি তবে জীবনে কী হচ্ছে তা নিয়ে ভাবব না। এতে জীবনের দুর্বিষহ দিনগুলো ও চমৎকার লাগবে। আমি তোমার কথাটা ভেবেছি বহুবার। আর সব ভেবে ই তখন জীবন কে জীবনের উপর ছেড়ে দিয়ে সৎ সাহস দেখিয়েছি। 

আমি অবাক হলাম৷ এসপি সাব আমাকে তুমি তুমি করছেন৷ তার মুখে আপনি শোনার চেয়ে তুমি শোনতে ভালো লাগছে।


বাড়ি ফিরে এলাম। মনে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা৷ অনেক দিন পর মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব৷ মনে হচ্ছে আমি যেন কী পেয়ে গেছি। সুন্দর কিছু। যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম এমন কিছু।  এটা কী এসপি সাবের জন্য?এই যে মানুষটা আমার সাথে এত আন্তরিক, এত মিষ্টি করে কথা বলে এটা ই কী তার কারন?সে একজন প্রশাসনের লোক আমি নিত্যান্ত বেকার যুবক আমার প্রতি তার এত আন্তরিকতা দেখে মন ভরে যায়৷ ভেতরে একটা সুখ সুখ অনুভব হয়।অতি প্রাচীন একটা ভালো লাগা কাজ করে। ইচ্ছে করে সারাদিন তার সাথে কথা বলি,তার বলা কথা শুনি। আরো অনেক কিছুর ই বাসনা হয়। যা বলা বারণ। 


দু দিন ধরে টানা বৃষ্টি। বাসা থেকে বের হওয়ার জো নেই৷ সারাদিন শুয়ে থেকে থেকে হাত পা ব্যথা হয়ে গেছে। এরি মধ্যে এক বিকেলে বাড়ির ল্যান লাইনে এসপি সাবের কল এলো। আমাকে আম্মু ডেকে বলল

-মুহিব,তুর ফোন। 

আমি ফোন ধরতে ই ও পাশ থেকে সেই কাঙ্কিত স্বরটা। 

-হ্যালো,মুহিব বলছো?

আমার গলা কেঁপে উঠলো৷ কিশোর তরুণের মত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলাম

-জ্বি। আপনি এসপি সাব?

-হ্যা,আমি এসপি তুরাব।

-কেমন আছেন?

-তোমার যে কোন খবর নেই৷ সেই যে কফি শপ থেকে বিদায় হলে আর তো তোমার খবর পেলাম না৷ কফি কী খারাপ ছিল?

-আরে নাহ। কী যে বলুন না৷ কফি খারাপ হবে কেন?

-তাহলে কী আমি ই খারাপ?

-না না, তা নয়৷ আসলে আপনার সাথে যোগাযোগের কোন উপায় ছিল না তো,তাই। 

-ছিল না?এই যে আমি যোগাযোগ করলাম। 

-আইন রক্ষক হিসেবে সেটা তো কঠিন কিছু নয়। 

-ওসব বাদ।আজ কি একবার দেখা হবে?

-বিকেলে আসি তাহলে থানায়?

-থানায় না৷ বাসাতেই থেকো। আমি বাইক নিয়ে আসব। 


সারা বেলা আমার বুক ধুকধুক করছিল। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মনে ভরে ছিল।বিকেলে রেডি হয়ে সোফায় বসে ছিলাম৷ ঠিক তখন দারোয়ান এসে বলল

-ভাইসাব,একজন আপনাকে ডাকে। 

আমি গেলাম৷ সে আজ মেরুন রঙের টিশার্ট পড়েছে।তার চোখে সানগ্লাস। আমাকে দেখে সানগ্লাস খোলল। আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না লজ্জায়। তাকে ও মনে হলো লজ্জা পাচ্ছে৷ সে কথা বলল

-এসো৷ এসে বসো। 

আমি গিয়ে তার বাইকে বসলাম। তার শরীরের ঘ্রাণ আমার মধ্যে মাদকতা তৈরি করে দিচ্ছিল। আমি একটু সরে ই বসেছিলাম। কিন্তু সে বলল

-একটু চেপে বস। আমি বাইক চালাতে আনাড়ি৷ পড়ে মরে গেলে আমার দায় হবে। 

আমি কম্পিত বুকে তার কাছে এসে বসলাম। সে বাইক চালালো। সারা রাস্তা টুকটাক অনেক কথা হলো। কিন্তু আমার‍ যে কেমন লাগছিল৷ এমন অনুভূতির কী নাম হয় বুঝে পাচ্ছিলাম না৷ মন কেমন করছিল। সেদিন ও কফি শেষে বাসায় ফিরে আসি৷ আমাদের অনেক কথা হয়।ওনার সাথে কথা বলতে কেন যে একটা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ মন মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনি। কথার ফাঁকে ফাঁকে তার চোখ,হাসি আমাকে বিভোর করে রাখে। 

আমি কী তাকে ভালোবেসে ফেলেছি?এমন ভাবে তো জহিরের প্রতি ও আমার টান ছিল না। সে ছিল আমার নিত্যান্ত বন্ধু আর এসপি সাব? সে কেন আমাকে এত কাছে টানে?রাতে ঘুম হচ্ছে না৷ খেতে ইচ্ছে করে না৷ আব্বুর খোটা,ভাইদের তিরস্কার, আন্দোলন সব কিছু পানশে আর গুরুত্বহীন লাগে৷ শুধু মনে হয়,আমার কেউ আছে৷ যে আমারে কাছে টানে। 


আজ নিয়ে দু দিন হলো এসপি সাবের কোন খোঁজ নেই। রোজ একবার হলে ও সে আমাদের ল্যান লাইনে ফোন করে। কিন্তু দু দিন হলো সে ফোন করেনি। আমার হাতে ফোন নেই। থানার নাম্ভারে কল করেছি বলল এসপি সাব ব্যস্ত। আমার মন কেমন করে উঠলো। আমি আর না পেরে থানায় চলে গেলাম। থানায় ঢুকে সোজা এসপি সাবের রুমে কিন্তু সেখানে সে নেই৷ হাবিলদার বলল এসপি সাব বেড়িয়েছেন। কখন ফিরবেন জানেন না৷ 

আমি অনেকক্ষণ বসে ছিলাম কিন্তু সে আসেনি। 

মন খারাপি নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে থানার সামনে চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। যদি সে আসে। সে থানায় আসেনি। রাত তখন এগারোটা। আমি হেঁটে বাড়ির পথ ধরলাম। ভেতরটা জ্বালা করছিল খুব। মনে হচ্ছিলা কিছু একটা হারিয়ে গেছে৷ 

বাসায় ফিরতে ফিরতে বারোটা। আমি বাসায় না ঢুকে গেইটের সামনে হিজল গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসলাম। চারদিকটা ফুলে লাল হয়ে আছে। আমার এ জীবনে এত হতাশা আর যন্ত্রনা আগে কখনো অনুভব হয়নি। 

ঠিক তখন গেইটের সামনে এসে কেউ একজন থামলো। আমি দেখলাম এসপি সাব৷ নিয়ন আলোয় তার অবয়বের ছায়া পড়েছে৷ আমি তার কাছে গেলাম না। সে ই এসে কাছে বসল। বসে বলল

-এত রাতে এখানে বসে আছ যে। 

আমি কিছু বললাম না। কারন কিছু বলতে গেলে আমি কেঁদে দিব। সে ই বলল

- আমার বদলি হয়ে গেছে৷ কাল আমি রাজশাহী চলে যাব৷ সারাদিন অনেক ছুটাছুটি করেছি বদলিটা আটকাতে। পারলাম না৷ অবশেষে তোমার কথাটা মনে হলো,জীবনকে নিজের মত ছেড়ে দিতে। তাই দিলাম। 

-আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। মনে হলো এই বুঝি সব শেষ৷ সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝড়তে লাগলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলাম

-আপনি চলে যাবেন?

-হ্যা৷ যেতে তো হবে ই। 

আমি এসপি মোহাম্মদ তুরাব এর দিকে তাকালাম। মনে হলো তার মন খারাপ। কেঁদে দিবে৷ আমি বেঞ্চে রাখা ওর হাতটা ধরতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মানুষের মত কেঁদে দিল। কতক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম খেয়াল নেই৷ তুরাব নিজেকে সামলে নিয়ে বলল

-বড় হয়েছি এতিম খানায়। বাবা,মা আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। হোস্টেলে থেকে, টিউশনি করিয়ে,কাজ করে নিজেকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছি৷ মানুষের সাথে মিশতে পারতাম না। সব সময় কেমন যেন হয়ে থাকতাম৷ তারপর, মারয়ং তং এ তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর মনে হয়েছিল জীবন খুব সহজ৷ তোমার বলা প্রতিটি কথা আমার কানে বাজে৷ তাই তো তোমাকে ফলো করতাম। কিন্তু সাহস করে কথা বলতে পারিনি৷ আজ যখন এতদিন পর কাছে এলাম তখন নিয়তি আমাদের দূরে ঠেলে দিল। 

আমি তুরাবের কথাগুলো শুনতে শুনতে ওকে দেখছিলাম আর ভাবিছিলাম, কী করব আমি?কী করে ওকে আটকাবো। 

আমি ওকে আটকাতে পারিনি। 


তুরাব চলে যাওয়ার এক মাস পরে আমার বিসিএস এর রেজাল্ট দিল৷ প্রশাসনে ৮ম। আমার পরিবারের সবাই খুশি৷ আমার সারা জীবনের কলঙ্ক ঘুচল। কিন্তু আমার মনে শান্তি নেই৷ এই এক মাস আমি রুম থেকে ও বের হয়নি। কারো সাথে কথা বলিনি৷ খাওয়া ব্যতিত অন্য কোন কাজে  নিচে নামিনি। রেজাল্টের খবর পেয়েছিলাম আপুর কাছে। যেদিন রেজাল্ট দিয়েছিল, তার দু দিন পর আমার মন আর স্থির থাকেনি। আমি ছুটলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। তাকে আমার একটা কথা বলার আছে৷ 


দরজায় দাঁড়িয়ে আছি ব্যাগ হাতে৷ রাত তখন আড়াইটা। বারবার কলিং বেল টিপছি। প্রশাসনিক কোয়ার্টার। অনেক ঝামেলা করার পর ভেতরে ঢুকার সুযোগ পেয়েছি৷ মিনিট পাঁচেক পর চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠে সে এসে সামনে দাঁড়ালো। আমার রাজপুত্র। আমাকে দেখে আকাশে চাঁদ পাওয়ার মত খুশি হয়ে বলল

-মু.মু.মুহিব

আমি কথা বাড়ায়নি৷ যা বলতে এসেছি তা বলে ফেললাম।আমি চোখ বন্ধ করে পাগলের মত একটানা বললাম

-আমি আপনাকে ভালোবাসি৷ আপনাকে ছাড়া আর বাঁচা যাচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। আমি আপনার সাথে লিভিং করার জন্য আন্দোলন করতে রাজি৷ 

তুরাব হেসে উঠলো। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলায় আলতো করে চুমু খেয়ে বলল

-আর দু দিন দেরি করলে আমি ই মারা যেতাম। 


বৃষ্টি নামলো। যাকে বলে ঝুম বৃষ্টি৷ বারান্দায় আমি আর তুরাব বসে কফি খাচ্ছি৷ এক হাতে কফি মগ অন্য হাতে তুরাবের হাত। কাল আমি জয়েন করব। জানি না, জীবনে কী আছে৷ তবে যা পেয়েছি তা ই যতেষ্ট। কারন আমি সুখি। 

.............সমাপ্ত.........













গল্প:প্রেমালিঙ্গণ গল্প:প্রেমালিঙ্গণ Reviewed by Men's Love on August 20, 2023 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.