গল্প:অপ্রেমের কাব্য-৩
লেখক:আরভান শান আরাফ
রাতে মুহিনের ঘুম হচ্ছে না কয়েকদিন যাবত৷ দুদিন বাদে ওর টেস্ট। আগে টেস্টের আগে প্রচুর ঘুম আসতো৷ ঘুমের জন্য ঠিকমত পড়তে পারত না অথচ আজকাল ঘুম ই আসছে না। গতরাতে সে স্বপ্নে দেখল ভার্সিটির ক্যাম্পাসে কারা যেন ওকে মারতে আসছে৷ মুহিন ভয়ে ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় ছুটছে৷ এমন দু:স্বপ্ন আজকাল প্রায় ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর৷ তারপর অনেক চেষ্টা করে ও ঘুমাতে পারে না। সেদিন রাতে মুহিন ঘুম না আসায় ছাদে গিয়েছিল। ছাদের পশ্চিম পাশে একটা দোলনা ঝুলানো। মুহিন সেটাতে গিয়ে বসতেই মনে হল কেউ একজন ছাদের অপর কোণায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে৷ মুহিনের উপস্থিতি টের পেয়ে সে ফোন রেখে মুহিনের দিকে আসতে লাগলো৷ কিছুটা কাছে আসার পরে ই মুহিন বুঝতে পারলো,এটা ওর দুলা ভাই তোফায়েল আজম৷
-আরে শালাবাবু,এত রাতে ছাদে কেন?ঘুম আসছে না?
মুহিন তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো প্রশ্ন করল
-আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন?
-কারো সাথে না৷ অফিসের কলিগ।
-মেয়ে?
মুহিনের প্রশ্ন শুনে তোফায়েল অট্ট হেসে উত্তর দিল
-ভয় পেয়ো না শালাবাবু,তোমার বোনকে ধোকা দিব না৷ ও ঘুমাচ্ছিল৷ রুমে কথা বললে ঘুমের ব্যাঘাত হত৷ তাই এখানে।
মুহিন আর কিছু বলল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে একটা গান ধরল৷ ঠিক তখন তোফায়েলের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো৷ তোফায়েল মোবাইলটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই ঐ পাশ থেকে একটা রাগি কন্ঠ ভেসে আসল৷ রাতের নিরবতায় মুহিনের মনে হলো, এই স্বরটা সে এর আগে ও শুনেছে। মুহিনের মন কেমন যেন করল।
ইশার মা নিলুফা মাহমুদ ফজর পড়ে ওনার ছেলে ইজহার মাহমুদের রুমে গেল। ইজহার দরজা খোলা রেখে ই ঘুমায়৷ নিলুফা মাহমুদ ধীরে ধীরে ইজহারের পাশে গিয়ে বসলো ইজহার একটা মেরিন কালারের টি-শার্ট পড়ে শোয়ে আছে৷ সারা রাত্রি এসি চলেছে। রুম ঠান্ডা হয়ে আছে৷ ইজহার বাচ্চাদের মত গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে৷ নিলুফা মাহমুদ ছেলের মাথায় হাত দিয়ে কেঁপে উঠলো৷ সেকি!খোকার জ্বর।
নিলুফা মাহমুদ দ্রুত দৌড়ে নিচে নেমে গোবিন্দ দাসকে ডক্টরের কাছে ফোন দিতে বলল৷ মায়ের চিৎকার শুনে ইশা দৌড়ে এলো
-কী হয়েছে মা?
-তুর ভাইয়ার জ্বর।
ইশা আর কথা বলেনি৷ সে ছুটে উপরে গেল। ইজহার ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগেছে৷ ইশাকে ছুটে আসতে দেখে বলল
-কিরে,কিছু কী হয়েছে?
-তোমার নাকি জ্বর?
ইজহার নিজের গায়ে হাত দিয়ে বলল
-নাহ তো৷ এই একটু গরম হয়ে আছে আর কি।
ইশা এই ফাঁকে ড্রয়ার থেকে থামোমিটার বের করে ইজহারের বগলের নিচে দিতে দিতে বলল
-হাত দিয়ে তো জ্বর ঠিক ই পাওয়া যাচ্ছে। তুমি না বললে কি আর জ্বর সেরে যাবে?
ইজহারের মাথা ভারী হয়ে আছে৷ সে ভাবছে সকালের স্বপ্নের কথা৷ খুব সুন্দর স্বপ্ন ছিল সেটা। কিন্তু কী স্বপ্ন সেটা মনে করতে পারছে না।
ইশা থার্মোমিটারটা বের করে অবাক হলো৷ জ্বর বেশি ই।
১০২ ডিগ্রী। ইশা রাগি রাগি চেহারা নিয়ে বলল
-এত জ্বর আর তুমি বলছ জ্বর নেই। চুপ মেরে শুয়ে থাক। কোন কথা বলবা না।
-আরে নাহ৷ জ্বর নেই।
-যা বললাম শুনো। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি৷ আজ আর নিচে নামতে হবে না।
-কী পাগলামি করছিস। তুই ভার্সিটিতে যা।
-যাব না। মুহিন কে বলে দিব,ও ক্লাস নোটস এনে দিয়ে যাবে।
মুহিনের নাম শুনে ইজহার চুপ মেরে গেল৷ তার মনে হলো মুহিন আসবে সেটা খুব আনন্দের বিষয়৷ পরক্ষণে রাগে তার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। ইশা বিষয়টা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল
-কী ভাই?মুহিনের নাম নিতেই তুমি রাগি ষাড়ের মত ফোঁসফোঁস করো কেন?
ইজহার কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেল।
মুহিন মন্ত্রীবাড়িতে আসতে চায় না৷ ওর কেমন যেন ভয় ভয় করে৷ কিন্তু সামনে টেস্ট৷ নোটস ছাড়া ইশার প্রিপারেশন খারাপ হবে। তাই বন্ধুত্ব্বের খাতিরে আসতে হলো। এত বড় বাড়ি, মুহিনের মনে হয় সে ঢুকে হারিয়ে যাবে কোথাও৷ দরজা খোলল বাড়ির কাজের লোক৷ মুহিন বলল
-ইশা কোথায়,ওকে ডেকে দেন না একটু৷
-ইশা আপা ত উপরে৷ আপনি উপরে চলে যান।
মুহিন ধীরে ধীরে উপরে উঠলো। উপরে এতগুলো রুম, কোনটা যে ইশার সে বুঝে উঠতে না পেরে ইশার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একটা রুমের দরজা খোলে দেখে খুব সুন্দর,বড় সড় গুছানো একটা রুম৷ মুহিন ভাবলো এটাই হয়ত ইশার রুম৷ সে ভেতরে ঢুকে অবাক হলো৷ এত সুন্দর কেন?মেঝের টাইলসে পা দিলে মনে হচ্ছে সারা শরীর শীতল হয়ে যাচ্ছে। সারা রুমে মেরুন কালার রঙ করা। দেয়ালে সমুদ্রের ওয়ালপেপার। রাজকীয় খাট। এক পাশে হোম থিয়েটার আর মিউজিক সিস্টেম। মুহিন মনে মনে অবাক হল। মানুষের এত টাকা।
মুহিনের হুশ ফিরল ইজহার মাহমুদের হুংকারে৷
-এই কে তুই?
মুহিন ঘুরে দেখে ইজহার মাহমুদ সামনে দাঁড়িয়ে৷ তার চুল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে৷ মুহিন ভয়ে দু'পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বলল
-জ্বি,আমি। ঐ ইশার কাছে এসেছিলাম।
ইজহার মাহমুদ দাঁত কিড়মিড় করে বলল
-এটা কি ইশার রুম?চোখে দেখ না?
মুহিন আর কথা বলেনি৷ সে ইজহার মাহমুদের এক পাশ দিয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে খাটের কোণে পায়ে আঘাত পেয়ে ইস করে উঠলো।
খোড়াতে খোড়াতে রুম থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই দেখে ইশা৷ ইশা মুহিন কে দেখে এক প্রকার চিৎকার করে ই বলল
-মুহিন!কবে এলি। আয় আয়।
মুহিন খোড়াতে খোড়াতে ইশার রুমে গেল। ইশা মুহিনের পায়ের দিকে তাকাল৷ জিন্স লাল হয়ে আছে৷
-কিরে,তুর পায়ে কী হয়েছে৷
বলতে বলতে ইশা ভেজা জায়গাটায় হাত দিয়ে আতকে
উঠে বলল
-এ যে রক্ত৷ পা কেটেছে কী করে?বস এখানে৷ আমি ফার্স্ট এইট নিয়ে আসি৷
ইজহার আধো শুয়ে বই পড়ছিল৷ ইশাকে এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে বলল
-কিরে,কী হয়েছে?
-ফার্স্ট এইডের বক্সটা কোথাহ ভাইয়া?ড্রয়ারে ই ত ছিল।
-কেন?
-আর বলু না,মুহিনের পা কেটে গেছে৷ রক্ত আসছে পা থেকে।
ইজহারের চেহারাটা মলিন হয়ে গেল। সে খাটের ওপাশ থেকে বক্সটা ইশাকে দিয়ে বলল
-বেশি কেটেছে?ডক্টর ডাকতে হবে?
-না না। ডক্টর লাগবে না।
ইশা চলে যাওয়ার পর ইজহার ভাবতে লাগলো মুহিনের কথা৷ আজকে ও সে ছেলেটার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে৷ তার জন্য ই মুহিন ব্যথা পেয়েছে৷ এমন কেন হয়?
ইশা মুহিনের পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ওর জন্য নাস্তা আনতে গেছে। মুহিন সোফায় বসে বসে ওর হাতের মোবাইল্প ফোন টিপছিলো। ঠিক তখন ইজহার মাহমুদ এসে রুমে ঢুকলো।
-তোমার নাকি পা কেটে গেছে?
মুহিন আতকে উঠে ইজহারের দিকে তাকালো।কিন্তু কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। ইজহার এগিয়ে এল
-কোথায় কেটেছে,দেখি।
মুহিন কিছু বলল না৷ কিন্তু ইজহার এগিয়ে এলো। মুহিন ওর জিন্সে টা গুটিয়ে উপরে তুলে ব্যান্ডেজ করেছিল। ইজহার মাহমুদকে আসতে দেখে সে সেই জিন্স ছাড়িয়ে ভয়ে নিচে তাকিয়ে রয়লো।
ইজহার কাছে এসে আমতা আমতা করে বলল
-আমাকে দেখে দৌড়ে পালাতে গেলে কেন?
মুহিন এবার কথা বলল
-আপনাকে দেখে দৌড়ে না পালিয়ে উপায় আছে?
-কেন?আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?
মুহিন বিড়বিড় করে বলল
-অমানুষ
-কী বললে?
-কিছু না। আমার কয়টা মাথা যে আপনাকে কিছু বলতে যাব। এত সাহস নেই আমার।
ইজহার আর কিছু বলেনি। সে এক দৃষ্টিতে মুহিনের দিকে তাকিয়ে ই আছে। এখনো সে বিড়বিড় করে যাচ্ছে৷ কী বলছে এই ছেলে?ইজহার আর দাঁড়ালো না।
ঐ ঘটনার দুদিন পর, মুহিনের খুব জ্বর উঠলো।সে জ্বর নিয়ে ই ভার্সিটিতে আসলো। ইশা মুহিনকে অনেক বুঝালো,ক্লাস না করে বাসায় চলে যেতে৷ কিন্তু মুহিন নাছোড়বান্দা। সে যাবে না বাসায়।
ক্যান্টিনের বারান্দায় মুহিন কে দাঁড় করিয়ে ইশা পানি আর কেক আনতে গেল৷ প্যারাসিটামল খাওয়ার জন্য।
মুহিনের জ্বর তখন ভয়াবহ। দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। সে বারান্দার একটা বেঞ্চিতে বসতে যাবে ঠিক মাথাটা চক্কর মারলো তার। চোখ দুটিতে ঝাপসা দেখছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, কেউ একজন দৌড়ে আসছে তার দিকে।
জ্ঞান ফেরার পর মুহিন দেখে সে ভার্সিটির কমন রুমে। তাকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে সবাই তার বন্ধু বান্ধব কিন্তু একজন কে সে ঠিক মনে করতে পারছে না৷ তাকে যেন কোথায় দেখেছে।কোথায় দেখেছিল?হ্যা এইতো মনে পড়ছে৷ জেলে দেখেছিল৷ এই মহিলা ই ওকে খাবার খেতে বলছিল বারবার।
পান চিবুতে চিবুতে সে কাছে এসে বলল
-ভালো ভালো আমি এসে ধরেছিলাম। না হয় মাথাটা ফেটে যেত।
মুহিন মহিলার দিকে ভাল করে তাকালো। বয়স ত্রিশ ও হবে না, একটা বাটিক প্রিন্টের শাড়ি পড়ে আছে৷শাড়ির আচলটা খুব ছোট। টেনে কোন ভাবে মাথায় দেওয়া৷ চোখে ঘন করে কাজল দেওয়া৷ হাসি হাসি মুখ৷ হাতে রেশমি চুড়ির রিনঝিন শব্দ তার কানে ঢুকতে তার হুঁশ এলো। ইশা ওর সামনে দাঁড়িয়ে। ইশাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল
-এই মুহিন,এখন কেমন লাগছে?
মুহিন আস্তে আস্তে জবাব দিল
-ভাল৷ মাথাটা ভারী হয়ে আছে৷ চল বাসায় যাব।
-দাঁড়া,ভাইকে বলি গাড়ি নিয়ে আসতে।
পাশে থাকা ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে উঠল
-এই মেয়ে,এ আমাদের দলের লোক। আমার গাড়িতে বাড়ি যাবে। তোমার ভাইয়ের গাড়িতে না।
-আপনার দলের লোক মানে?
মহিলা কিছু না বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কে ইশারা দিল৷ সে এসে মুহিনের হাতে ধরল
-চলেন ভাই,আমাদের গাড়িত আসেন। বাড়িতে পৌঁছে দিব।
মুহিন বাধ্য ছেলের মত গিয়ে গাড়িতে উঠল।মুহিনের পাশে গিয়ে বসল ভদ্রমহিলা। ইশা 'থ' হয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখল আর মুহিনের প্রতি রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।
বাড়ির সামনে এসে ভদ্রমহিলা বিস্ময়ে বরফ হয়ে গেল। মুহিন কে বলল
-এই মুহিন,এই বাড়িতে থাক তুমি?
-জ্বি,এটা আমার বোনের শুশ্বড় বাড়ি।
-তোমার বোন?তোমার দুলা ভাইয়ের নাম কী?
-তোফায়েল।
মহিলা কিছু বলল না৷ তার চেহারাটা মলিন হয়ে গেল৷ মুহিন সেটা লক্ষ্য না করে গাড়ি থেকে নেমে গেল৷
ভদ্রমহিলার নাম শারমিন৷তার বাবা ছিলেন এক সময়কার সবচেয়ে বড় এডভোকেট৷বিয়ে হয়েছিল৷ কিন্তু কোন এক কারনে সে নিজেই সেই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে৷ এখন রাজনীতি করে। সাধারণ মানুষের রাজনীতি।তার চার ভাই লন্ডনে থাকে৷ তুই বোন ডক্টর। সে আইনজীবী ছিল।লাজুক,মিষ্টিভাষী মেয়েটা একদিন হয়ে উঠল তুখোড় রাজনীতিবিদ।বর্তমান মন্ত্রির স্নেহভাজন। সামনের বার মেয়র পদের জন্য দাঁড়াবে হয়ত।
ইশা বাসায় ঢুকে রেগে আগুন হয়ে আছে৷ ইজহার তখন তাদের বাসাতে ছিল৷ ইশাকে রেগে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল কী হয়েছে৷ ইশা রেগে শারমিন সুলতানার সব কথা বলল। সব শুনে ইজহার বলল
-এসব ছেলেরা এমন ই৷ ওদের থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম।
-সে কি কথা!এখানে মুহিনের দোষ কোথায়?
-শারমিনের দলের লোক বলে ই তো মেশা উচিত না। ওরা খুব চালবাজ।
-মুহিন তো রাজনৈতিক চিন্তাধারার ছেলে না।
-তুই বুঝবি না।
-তোমাকে বুঝাতে হবে না।
ইশা রেগে নিজের রুমে চলে গেল।
সন্ধ্যায় মুহিন ইশাকে অনেকবার ফোন করে না পেয়ে ওদের বাসার টেলিফোনে ফোন করল। দু তিনবার ফোন বাজার পর ইজহার ফোন ধরল
-হ্যালো,কে?
ইজহারের কন্ঠস্বর শুনে মুহিন ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল
-জ্বি,ইশা আছে?
-তুমি কে?
-আমি মুহিন৷
-তুমি ফোন করেছ কেন?
-ইশার ফোন অফ।
-তুমি আর ওকে ফোন দিবে না৷ খবরদার ফোন দিবে না৷
মুহিন ভাবলো,এই লোকটাকে দুটো কথা শুনানো দরকার বারবার চুপ করে চলে আসা ঠিক হচ্ছে না। সে চেচিয়ে বলল
-দিব,হাজার বার ফোন দিব৷ আপনার কি সমস্যা?
ইজহার রেগে অগ্নি শর্মা হয়ে বলল
-চুপ,একদম চুপ৷ খুন করে ফেলব।
-কেন চুপ করব?ইশা আমার বন্ধু,ওকে ফোন করার অধিকার আমার আছে৷ আপনার এত সমস্যা কেন?
-তুই সামনে আয় একদিন হারামজাদা।
-আমি হারামজাদা না,আপ......।
ইজহার ফোন রেখে দিল৷ মুহিনের ভাল লাগছে দুটো কথা শুনাতে পেরে।এই লোক বড্ড জ্বালায় ওকে। এত ঘৃণা কেন মানুষের প্রতি।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে হুট করে বৃষ্টি নামলো। মুহিন গিয়েছিল ফোনে টাকা রিচার্জ করতে৷ আকস্মিক বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সে একটা কনিফেকশনারি স্টোরে গিয়ে ঢুকলো। ওর শরীর ভিজে গেছে৷ দুদিন আগে জ্বর থেকে উঠেছে৷ বেশি ভিজলে আবার জ্বর আসতে পারে ভেবে শরীরের টি-শার্টটা খোলে পানি চিপে ঝাড়ি দিচ্ছিল৷ তার একটু দূরে গাড়িতে বসে ইজহার মাহমুদ এদিকে তাকিয়ে ছিল।মুহিনকে দেখে তার চোখ সেদিকে আটকে গেল।সে অবাক হয়ে দেখছিল মুহিনের ভেজা শরীরের সৌন্দর্য।তার কামুক মনে মুহিনকে এভাবে দেখে নেশা ধরে গেল। এমন অল্প বয়সী তরুণ ছেলে,তার সরু কোমড়,গভীর নাভী,ফর্সা শরীর ইজহারকে মাতাল করে দিল। মুহিন দু'মিনিটের মত খালি শরীরে ছিল৷ পরক্ষণে টি শার্টটা পড়তে পড়তে একবার রাস্তার দিকের গাড়িটির দিকে তাকালো। তার মনে হল গাড়ি থেকে কেউ তাকে দেখছে৷ কে হতে পারে?মুহিন স্টোরের ভেতরে চলে গেল। স্টোরের মালিক ষাটোর্ধ বয়সের। মুহিন তাকে কাকা বলে সম্বোধন করেন।তিনি একটা গামছ মুহিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
-ভাতিজা,মাথাটা মুছে ফেলো৷ নতুবা জ্বর আসবে।
মুহিন গামছাটা নিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে খেয়াল করল গাড়িটা নেই।তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হল,গাড়িতে ইজহার মাহমুদ ছিল না তো?
ইজহারের মনে মুহিনের খালি শরীরের চিত্র গেঁথে আছে৷ ওর মনে হচ্ছে ঠিক এই মুহুর্তে ওকে ওর প্রয়োজন৷ পরক্ষণে একটা এমন ছেলের জন্য ওর মনের ছটফটানির জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলো।
মুহিন ছাদে বসে বসে পেছনের দিনগুলোর কথা ভাবছিল। সে যার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল,সে ছিল বিবাহিত। কোন ইজহার এত কিছু দেখেনি৷সামাজিক যোগাযোগ সাইটে তাদের পরিচয়৷ শারিরীক সম্পর্ক হওয়ার পর যখন ইজহারের মন স্বপ্ন বুনা শুরু করেছিল ঠিক তখন সে জানতে পারল সে বিবাহিত।
সেদিন তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। সে তখন কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ বিকেলের দিকে বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে বাসায় ঢুকার আগে বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে রেশমি শাড়ি পড়া একজন মহিলা নামল। ইজহার এর আগে এই মহিলাকে কখনো দেখেনি৷ সে ইজহারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
-কেমন আছেন?
ইজহার বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল
-আপনি কে?
মহিলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
-গতকাল রাতে যার সাথে ছিলেন আমি তার স্ত্রী।
ইজহারের মনে হল ভয়ানক নোংরা কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইজহার হতবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকাল৷ মহিলা এখনো তাচ্ছিল্যের চোখে ই তাকিয়ে আছে৷ ইজহার ঘাবড়ানোর সুরে প্রশ্ন করল
-কী বলছেন আপনি?
-কী বলছি বুঝো নাই?লজ্জা করে না তোমার? একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলের সাথে.. ছি! ভাবতে ই পারিনি আমার স্বামী এমন নোংরা মানসিকতার।
-দেখেন,আমি জানতাম না যে সে বিবাহিত।
-জানতে না?মেয়রের ছেলে তাই কোন পদক্ষেপ না নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। তা নাহলে,আজ বুঝাতাম যে, আমি কে।
ইজহার চুপ৷ তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ নিজেকে সামলে রুমে এসে মরার মত দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়েছিল তিন দিন৷ এই তিন দিনে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল। তার সেই প্রতারক প্রেমিককে তার স্ত্রী ডিভোর্স দেয়৷ তার নামে মিথ্যা মামলা করে৷ সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিল তাই অল্পতেই বেঁচে যায়৷ কিন্তু ইজহারের মন বিষিয়ে গিয়েছিল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল সে। এত দিনের সম্পর্ক অথচ সে একদিনের জন্য ও বুঝতে পারেনি যে তার সাথে প্রতারণা হচ্ছে।
ইজহারের এসব কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল৷ যতদিন সে নিজেকে গুছিয়েছে ততদিন অনেক কিছু বদলে গেছে৷ ওর বাবার মৃত্যু। মেয়র পদের জন্য ওর নির্বাচন,দাঙ্গা,মামলা আরো অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে ওকে যেতে হয়েছিল৷ জীবন তাকে এমনি এমনি এত শক্ত করে গড়েনি৷ এর পেছনের কারন অনেক বিশাল,অনেক বড়।
ইজহারের প্রতারক প্রেমিক আবারো বিয়ে করেছে৷মাঝে মাঝে ইজহারকে ফোন করে৷ টুকটাক কথা বলে৷ ইজহার চাচ্ছে না তার সাথে ওর আর কথা হোক৷ কিন্তু একদিনের পাগলের মত ভালবাসার স্মৃতি ওকে বাধ্য করে কথা বলতে৷তাছাড়া ওর একাকিত্বের জীবনে কথা বলার মত ও কেউ নেই।তার সাথে ওর সম্পর্কটা অনেকটা সহজ। বন্ধুত্বের মত৷ পেছনের আবেগ কবে ই জ্বালিয়ে ছাই করে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে সে৷ এখন কেবল বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা৷
মুহিনের ঠিক ই জ্বর এসেছে৷ আর ওদিকে ওর আপু দুলাভাই আগামীকাল ইন্ডিয়া যাচ্ছে বারো দিনের জন্য৷ সাথে ওর দুলাভাইয়ের বাবা মা ও৷ মুহিন যেত কিন্তু ওর টেস্ট৷ সারা বেলা মুহিন এমন একটা ভাব করেছে যেন ও সুস্থ্য৷ কিন্তু বেলা যত বাড়ছিল তার সাথে জ্বর ও বাড়ছিল। রাতে জ্বর এত বেড়ে গেল যে ওর আপু ওকে রেখে ইন্ডিয়া যেতে মানা করে দিল। মুহিনের কারনে তাদের এতদিনের ভ্রমণ বিনষ্ট হবে ভেবে নিজেকে সুস্থ্য প্রমাণ করতে রাতে ই বাসা থেকে সবজি কেনার কথা বলে বের হয়ে গেল।
রাত নয়টা হবে৷ সবজি বাজার ঘুরে ঘুরে মুহিন কিছু পটল আর টমেটো কিনে যখন সাইকেলে উঠতে যাবে ঠিক তখন আবারো মাথাটা চক্কর মারলো। সাইকেলের প্যাডেল চাপার সাথে ধপাস করে সাইকেল থেকে পড়ে গেল। আশেপাশে লোকজন এসে জড়ো হল কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না৷ ঠিক তখন ইজহার মাহমুদ গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল৷ জটলা দেখে ড্রাইভারকে পাঠালো জটলা সরাতে।
ইজহার মাহমুদের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দেখে মুহিন রাস্তায় পড়ে আছে৷ মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে৷ সে চিৎকার করে ইজহার মাহমুদকে ডাকলো। ইজহার ছুটে এসে মুহিন কে দেখে হতভম্ব। সে তাকে কুলে করে নিয়ে গাড়িতে বসালো৷
রক্ত পড়া আপাতত বন্ধ আছে। নিলয় চোখ খোলে ভূত দেখার মত চমকে উঠে বলল
-একি!আমি গাড়িতে কেন?আমার সাইকেল কয়?লাল রঙের সাইকেলটা?
ইজহার মাহমুদ পাশে ই ছিল। মুহিন সেটা খেয়াল করেনি। তার জ্বরটা এখন কম। সে আবারো বলল
-আমার পটল গুলো?
মুহিন এবার খেয়াল করল ইজহার হাহমুদ তার পাশে ই বসা৷ মুহিন ভূত দেখার মত চমকে উঠল । একি!সে ইজহার মাহমুদের গাড়িতে কেন?মুহিন ভয় পেয়ে প্রশ্ন করল
-আপনি?আমি গাড়িতে এলাম কীভাবে?
ইজহার মাহমুদ কোন উত্তর দিল না৷ উত্তর দিল গাড়ির ড্রাইভার।
-তুমি মাথা ঘুরিয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলা৷ মেয়র সাব তোমারে গাড়িতে এনে রাখল। তোমারে বাড়িতে দিয়ে আসব।
মুহিন ইজহারের দিকে তাকাল।ইজহার বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মুহিনের ইচ্ছে করছিল গাড়ি থেকে নেমে যেতে কিন্তু সে শক্তি পাচ্ছে না৷
ইজহার মুহিন কে নামিয়ে দিল৷ কেউ কোন কথা বলেনি৷ মুহিন বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিল লোকটাকে একবার ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। যতটা খারাপ সে তাকে ভাবত ঠিক ততটা খারাপ হয়ত নয়৷ মুহিন সোজা রুমে চলে গেল৷ আয়নার সামনে বসে মাথায় একটা টেপ লাগিয়ে, একটা প্যারাসিটামল খেয়ে বিছানায় শোয়ার সময় তার চোখে ইজহার মাহমুদের চেহারাটা ভেসে উঠল। লোকটা সারাক্ষণ রেগে থাকে কিন্তু তার চোখ দুটো যেন অনেক সরল৷ একবার তাকালে ই মনের সব কথা পড়ে নেওয়া যাবে। একটা কাঠিন্যতার মুখোশ পড়ে রাখে সে৷
পরের দিন খুব ভোরে মুহিনের বোনেরা সবাই ইন্ডিয়ার জন্য বাড়ি ত্যাগ করেন৷ সুবর্ণা বারবার মুহিনকে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা বলল কিন্তু মুহিন ভাবলো সে একা ই থাকবে।
সেদিন দুপুরে হুট করে ইশা এসে উপস্থিত৷ এসে সোফাতে বসতে বসতে বলল
-ব্যাগ গুছিয়ে নে৷
মুহিন বিমর্ষ চেহারায় উত্তর দিল।
-ব্যাগ গুছাতে হবে কেন?
-তুই এ কয়দিন আমাদের বাসায় থাকবি।
-ধুর ধুর। তা কেন?
-তুই যাবি কিনা বল?আর না গেলে আমাদের বন্ধুত্ব এখানেই শেষ৷ আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি৷ আধা ঘন্টা সময়।
মুহিন পড়ল মহা ঝামেলায়৷ ইশা তার ভাল বন্ধু৷ তাই বলে তাদের বাসায় এত দিন গিয়ে থাকা উচিত হবে না। তারুপরে ঐটা ইজহার মাহমুদের বাড়ি।
.....................(চলমান)
সবসময় অপেক্ষায় থাকি আপনার গল্পের😁
ReplyDeleteTake love