লেখকঃ-আরভান শান আরাফ
আমার বারো তেরো বছর বয়সে একদিন সন্ধ্যায় পূব পাড়ের কবরস্থান হয়ে বাড়ি ফেরার পথে শেয়ালের ডাক শুনে জ্বর এসে গিয়েছিল৷ ছোট সময় থেকেই ভিতু ছিলাম। একবার ছোটকা সাথে করে মাছ ধরতে নিয়ে গিয়েছিল ভোর রাতে৷ আমাকে পুকুর পাড়ে দাঁড় করিয়ে সে পুকুরে নেমেছিল৷ পুকুরের অপর পাড়ে বাঁশঝাড়ে সাদা বক দেখে ভূত ভেবে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিলাম। সেই সব কথা আজো মনে উঁকি মারে৷ কত ভীতু ছিলাম।
ঐদিন যে ভদ্রলোক নিলয়দের বাসায় মদ খেয়ে ঢুকেছিল সে সম্ভবত নিলয়দের কিছু হয়৷ আমি নিলয়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে যা দেখি তা দেখার জন্য আমি মোটে ও প্রস্তুত ছিলাম না। ঐ লোকে নিলয়ের গলা চেপে ধরে আছে আর নিলয়ে ছুটার জন্য ছটফট করছে। নিলয়ের মাকে অন্য রুমে আটকে রেখেছে৷ সেখান থেকে তিনি দরজার ধাক্কাচ্ছে আর চিৎকার করছে৷ এ দৃশ্য দেখার পর আমার মাথা স্থির ছিল না। আমি হাতের সামনে যা পেয়েছি তা দিয়ে ভদ্রলোকের মাথায় আঘাত করি। আঘাতটা খুব বেশি ছিল না কিন্তু ঐ লোক অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পরে যায়। নিলয় মাটিতে বসে দ্রুত শ্বাস নিতে লাগলো। আমি ওকে ছোঁতে যাব ঠিক সেই সময় ও হেসে উঠল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-হাসছ কেন?
নিলয় হাসতে হাসতে বলল তরকারি নাড়ার চামচ দিয়ে প্রথম কাউকে বারি দিতে দেখলাম। আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি হাতে তরকারির চামচ।
বিষয়টা,হাস্যকর। তবে এতটা ও নয় যে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তে হাসা যাবে।
বাসায় চলে আসলাম৷ ভয়ে তখন বুক কাঁপছিল৷ আমি যদি ভারী কোন কিছু দিয়ে ঐ লোককে আঘাত করতাম তবে? ডাক্তারের কাজ জীবন বাঁচানো আর তখন আমি কারো মৃত্যুর কারন হতাম৷
দু'দিন পর দুপুরে নিলয় আমার চেম্বারে আসল। নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি একটা মানুষকে এত সুন্দর করতে পারে সেটা ভাবিনি৷ সে এসে আমার সামনে বসল।
আমি চেহারায় যথেষ্ট গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলাম
-তা, কিসের জন্য আসা হলো?
নিলয় কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল৷ ওর চোখ,ঠোট শরীর আমাকে প্রবলভাবে টানছে৷ ইচ্ছে করছিল ওর ঠোঁট ছোঁয়ে দিতে আমার ঠোঁটে৷ ওর চোখের পাপড়িতে চুমু খেতে।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম
-কিছু হয়েছে?
-নাহ৷ হয়নি।
-তাহলে?
-আপনাকে দেখতে এসেছি।
আমি মুচকি হেসে বললাম
আমাকে দেখার কী আছে?
-কিছু নেই। চলে যাচ্ছি।
বলেই হন হন করে বের হয়ে গেল। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম শুধু।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে খেয়াল করলাম নিলয় ওর বয়সী একটা ছেলের সাথে ঈদগাহ মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে৷ সেটা দেখার পর আমার মন কেমন যেন হয়ে গেল। সেটাকে হিংসা বলা যায় আবার রাগ ও।
মনে হলো, সে কেন অন্যদের সাথে কথা বলবে?সে হবে শুধু আমার৷ কথা বলবে শুধু আমার সাথে৷।
বাসায় ফিরে গোসল করে খাবার টেবিলে বসব ঠিক সেই সময় নিলয় এলো। আজ আর হাতে কিছু নেই৷
আমি ওকে দেখে ও না দেখার ভান করে খাবারের প্লেটে ভাত নিতে লাগলাম। জমিরউদ্দীন এক প্রকার চিৎকার করে ই বলল
-অ আল্লাহ! বাবা জীবন যে৷ কীতার জন্য আয়ছুইন?
নিলয় এসে ঠিক আমার পাশে বসতে বসতে বলল
-আজ ডাক্তার সাবের সাথে খেতে আসছি।
জমিরউদ্দীন তাকে একটা প্লেট দিল।
আমি তাকালাম নিলয়ের দিকে৷ওর চোখের দিকে তাকাতেই আমার রাগ ঝড়ে গেল৷ আমি প্লেটে ভাত দিতে দিতে বললাম,
-আজ হঠাৎ আমার সাথে খেতে ইচ্ছে হল?
-ইচ্ছে না৷ খিদা লেগেছে৷
-কেন?সারাদিন খাওনি?
-নাহ৷ রান্না হয়নি।
-রান্না হয়নি কেন?
-সালাম মিয়া এসেছে।
-সালাম মিয়া কে?
-কে আবার,আমার বেজন্মা বাপ।
আমি বিস্ময়ে তাকে রইলাম। জন্মদাতা পিতাকে এমন ভাবলেশহীন ভাবে নাম ধরে ডেকে গালি দিতে প্রথম কাউকে শুনলাম।
ছোটকা এসেছিল গতকাল সন্ধ্যায়। হাত ভর্তি রাজ্যের বাজার সদাই৷ মুরগি,মাছ,হাঁস, ফলমূল।আমি তখন বারান্দায় বসে বসে সার্জারির উপর একটা বই পড়ছিলাম৷ছোটকার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নিলয় বের হয়ে এলো। কাকাকে দেখে নিলয় ছুটে গেল৷ কাকা আনন্দে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে পকেট থেকে কী যেন একটা দিল৷। আমি অবাক হলাম৷ ছোটকার সাথে নিলয়ের পরিচয় কীভাবে?এত স্নেহ তো ছোটকা শুধু আমাকে ই করেন।নিলয়ের প্রতি এত আবেগের কারন কী?
সেদিন যাওয়ার আগে ছোটকাকে জিজ্ঞেস করি
-ছোটকা, নিলয়কে চিন কীভাবে?
ছোটকা প্রাণখোলে অট্টহেসে বলল
-তর বজলুর কথা মনে আছে?পূব পাড়ার?
আমার মনে পড়ল বজলু কাকার কথা। ছোটকার একমাত্র বন্ধু। সেই ছোট বেলা দেখেছিলাম৷ বাবড়ি চুল,হাতে সিগারেট, সাদা লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াত। আমাকে অনেক স্নেহ করতো।
আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম
-হ্যা,মনে আছে তো।
-নিলয় হয়ল গিয়া আমাদের বজলুর ছোট ভাই সালামের ছেলে।তবে ছেলেটা বজলুর বাড়িতেই মানুষ।
আমি আর কথা বাড়ায়নি সেদিন। শুধু মনে মনে এই ভেবে খুশি হলাম যে, নিলয় আমার কিছু একটা হয়।
নিলয়কে বুঝা খুব কঠিন। ওর মন যখন যেটা চায় সে সেটাই করে। ঐদিন দুপুর বেলা হুট করে চেম্বারে ঢুকে গেল। আমি তখন প্রেশেন্টের সাথে কথা বলছিলাম। তাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-কী হয়েছে, হঠাৎ?
-পাঁচটা টাকা দেন তো।
আমার কেমন যেন লাগলো। পাঁচ টাকার জন্য কেউ তিন তালা বেয়ে উঠে?আমি ওয়ালেট বের করে পাঁচ টাকার খুচরা না পেয়ে একশো টাকার নোট দিয়ে বললাম
-পাঁচ টাকা নেই৷ একশ টাকা ই আছে৷
নিলয় একশ টাকার নোটটা নিয়ে দৌড়ে নিচে নামল৷ পাঁচ মিনিট পর আবার উপরে উঠে এসে আমার হাতে এক গাদা খুচরা পয়সা দিয়ে বলল
-দেন,আমার পাঁচ টাকার ই দরকার ছিল।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,
-পাঁচ টাকা কিসের জন্য নিলে,শুনিতো
নিলয় পেছনে রাখা হাতটা বের করে দেখালো
ওর হাতে একটা বাঁশের বাঁশি। আমি জিজ্ঞেস করলাম
-বাঁশি কিসের জন্য?
নিলয় প্রফুল্লচিত্তে উত্তর দিল
-কৌশিক দা বলেছে আমায় বাঁশি বাজানো শিখাবে৷ অনেক দিন ধরে কেনার জন্য খোঁজছিলাম৷ আজ রাস্তায় বিক্রি হচ্ছিল। পঞ্চাশ টাকা করে। আমার কাছে পাঁচ টাকা কম ছিল, তাই নিলাম আপনার থেকে।
আমি খেয়াল করছিলাম,একটা বাঁশি কিনে ছেলেটা কত খুশি। অথচ দিনের পর দিন আমি এই খুশিটার জন্য কত ছটফটিয়েছি। নিলয়কে খুশি দেখে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। এই প্রশান্তির কী নাম?মায়া নাকি ভিন্ন কিছু।
গতকাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছিল৷ আমি জানালা খোলা রেখে ঘুমাই মাঝ রাতে বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা বাতাসে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি বৃষ্টি৷ আমি জানালা বন্ধ করলে বৃষ্টির শব্দ বন্ধ হয়ে যাবে তাই জানালা খোলা রেখে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আজ হঠাৎ বৃষ্টির শব্দটা এত ভাল লাগছে কেন?আগে তো এমন হয়নি৷ একটা কিশোর ছেলের প্রতি আমার এই আসক্তির কী নাম দিব? এই আবেগের কী পরিণিতি? এসব এলোমেলো শত চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। কখন চোখ লেগে গিয়েছিল সেই খেয়াল ছিল না৷ রাতে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ সকালে সেটা আর মনে ছিল না। মনে পড়ল মধ্য দুপুরে রাস্তায় এক পাগলিকে দেখে।
....চলবে--
nice
ReplyDelete