গল্পঃ--অমাবস্যার চাঁদ -পর্ব ২
(অর্ধচন্দ্র)
আরভান শান আরাফ
চেম্বারে বসে বসে এক প্রকার মশা ই মারছিলাম। রোগী তেমন নেই৷ নতুন নতুন প্র্যাক্টিস শুরু করেছি একটা বেসরকারি হাসপাতালে। হাসপাতাল টা ও নতুন৷দশ বারো জনের মত এসেছিল। এখন আপাতত অবসর৷ ঠিক সেই সময় ঐদিনের ছেলেটা ঢুকলো৷ সাথে একজন মহিলা, সম্ভবত ছেলেটার মা। আমি একবার চোখ তুলে তাকিয়ে রিপোর্ট গুলোতে চোখ বুলাতে লাগলাম।সব কিছু মোটামুটি স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অসুস্থ্য৷
আমি প্রশ্ন করলাম
-রিপোর্ট ঠিক আছে। অন্য কোন সমস্যা আছে নাকি?
কথা বলল ছেলেটার সাথে থাকা ভদ্রমহিলা
-ঐদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে খেতে চায় না, রাতে ঘুমায় না৷ সারা রাত্রি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। আপনি ঔষধ দেন যেন ঠিকমতো খাবার খায় আর রাতে ঘুমায়।
আমি কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে প্রশ্ন করলাম
-রাতে হাঁটো কেন?
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল
-ঘুম না এলে আর কী করব? আপনি ঘুম পাড়িয়ে দিবেন?
ওর চোখ দুটি যেন কেমন। উদ্ভ্রান্তের মত। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। কেমন নেশা ধরে যায়।
আমি লজ্জায় আর কথা বাড়ায়নি। স্লিপিং পিল আর মাল্টি ভিটামিনের কিছু মেডিসিন প্রেস্ক্রাইভ করে কিছু দিন পর আসতে বললাম৷
এর দুদিন বাদে ছেলেটা আরেকবার এলো৷ সেদিন সে একা। অনুমতির অপেক্ষা না করেই চেম্বারে ঢুকে গেল৷ আমি তখন একটা বই পড়ছিলাম৷ চোখ তুলে তাকাতেই বুকটা কেমন করে উঠলো।
ছেলেটা বসতে বসতে বলল
-ডাক্তার সাব,কেমন আছেন?
আমি বই থেকে মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশন এর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার হাতে প্রেসক্রিপশন না দিয়ে একটা টিফিন বক্স দিল৷ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম
-এটা কী?
-আম্মু দিলো আপনাকে।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না৷ আমার এই স্বল্প ক্যারিয়ারে ফার্স্ট টাইম কেউ কিছু দিল৷ আমি ভদ্রতার খাতিরে বক্স টা পাশে রেখে বললাম,
-তো আজ কোন শারিরীক অসুস্থ্যতায় আসা হলো?
-অসুস্থ্যতা নেই তো। আমি তো ফিট এন্ড ফাইন।
বলেই হাসতে লাগলো। ১৭/১৮ বছরের একটা যুবক ছেলে কিশোরের মত প্রাণ খোলে হাসতে লাগলো। আমার মন ভরে উঠল তার হাসিতে।
চলে যাওয়ার পর টিফিন বক্সটা খোললাম। মাংস জাতীয় কোন খাবার হবে৷ চামচ দিয়ে অল্প মুখে দিতেই মনে হলো অমৃত খাচ্ছি। এর চেয়ে সুস্বাদু খাবার এর আগে কখনো খাইনি। মনের বেখেয়ালে কখন যে সবটা খেয়ে নিলাম বুঝে ই আসেনি৷
খুব কম মানুষ ই আমাকে ভালবেসেছিল৷ কলেজে পড়ার সময় থার্ড ইয়ারে জয়িতা নামের এক মেয়ে প্রায় ফোন দিতো।ইচ্ছে হলে ধরতাম আবার কখনো অফ করে রেখে দিতাম৷ নানান ভাবে মনের কথা বুঝানোর চেষ্টা করত। আমি বিরক্ত হতাম। এড়িয়ে যেতাম৷ আজ এত দিন পর জয়িতার কথা কেন মনে হল বুঝতে পারছি না৷ জয়িতা এখন কানাডায়। কেমন আছে সে? হয়ত ভালো আছে।
সকাল থেকে টানা বৃষ্টি।হালকা নাস্তা খেয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে বারান্দায় চা নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে খেয়াল হলো ঐদিনের ছেলেটা রাস্তায় ফুটবল নিয়ে খেলছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো একবার ডেকে জিজ্ঞেস করি ওদের বাসা এই দিকে ই কিনা৷ তাছাড়া, ঐদিনের খাবারের জন্য ধন্যবাদ ও দেওয়া হয়নি।
আমি এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলাম
-এই ছেলে শুনো
ও আমার কন্ঠ শুনে এগিয়ে এসে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-আরে ডক্টর সাব৷ কিছু বলবেন?
-তোমাদের বাসা এই দিকে?
-জ্বি,পাশের বিল্ডিংটা ই আমাদের।
আমি অবাক হলাম৷ আমার বাড়ির পাশে ওদের বাড়ি অথচ কোন দিন দেখিনি৷ দেড় বছর হলো এখানে আছি। অথচ খেয়াল ই করিনি।
-কিছু বলবেন?
-নাহ।।
আমি রুমে এসে রেডি হয়ে গাড়িতে বসলাম৷ মন কেমন অশান্ত হয়ে উঠল৷ ইচ্ছে করছিল বারান্দায় বসে থাকি৷ ছেলেটার ফুটবলে লাথি মারা, দৌড়-ঝাঁপ দেখি৷ ওর কুকড়ানো চুলের জলবিন্দু আর খাড়া নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলরাশি দেখি। কী হচ্ছে আমার?ওর প্রতি এত মুগ্ধতা কেন আমার?
এর পর অনেক গুলো দিন কেটে যায়। আমি রোজ বারান্দায় বসি। কখনো ওর দেখা পায়, কখনো পায় না৷ যেদিন দেখা পায় সেদিন মন শান্ত থাকে৷ যেদিন দেখা হয় না সেদিন মনটা কেমন যেন করে। অস্থির অস্থির লাগে।কথা হয় না৷ কিন্তু ওকে দেখতে ভাল লাগতো৷ আমার এই পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে এক সদ্য যুবকের প্রতি এত মুগ্ধতা কেন?
সেদিন দুপুরে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই ও আমার সামনে৷ আমি লজ্জায় পড়ে জিজ্ঞেস করি
-এখন তোমার শরীর কেমন?
-ভাল না?
-কেন?
-বুকে ব্যথা৷
-কখন থেকে?
-দু'দিন ধরে৷
আমার মন বিষণ্ণতায় ভরে গেল৷ আমি কিছু বলতে যাব তার আগে ই তাকে দেখলাম হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে চলে যাচ্ছে৷ এই ছেলেকে দেখলে কেউ বুঝবে না যে ওর হার্টে ছিদ্র হয়ে আছে৷ আহা! এত সুন্দর একটা ছেলে!
সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল কান্নার শব্দ শোনে। আমি জমির চাচাকে খোঁজ নিতে পাঠালাম৷ জমির চাচা মিনিট দুয়েক পরে এসে বলল
-নিলয় এর বুকে ব্যথা৷ বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে৷ বাসায় মাজননী ছাড়া কেউ নেই৷
-নিলয় কে?
-ঐ যে বাঁকা চুলের লম্বা ফর্সা ছেলেটা আছে না ঐটা৷
আমার হৃদয় কেঁপে উঠল। আমি দ্রুত এম্বুলেন্স ফোন দিয়ে ওদের বাসায় গেলাম।
নিলয় আমাকে একবার দেখে আবার জ্ঞান হারালো৷ কীভাবে কাকী আর ওকে নিয়ে ঢাকা হৃদরোগ ইন্সটিটিউট এ পৌঁছলাম সেই খেয়াল নেই৷ যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করানোটা জরুরি ছিল।
পরিচিত কিছু মানুষের সাহায্যে রাতের মধ্যে ওকে হৃদরোগে ই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর সকালে ওকে নিয়ে গেলাম হার্ট ফাউন্ডেশনে। সেদিন ই ওর হার্টে সার্জারী করানো হলো। ওর মাকে দেখেছি সারাক্ষণ ওর হাত ধরে বসে থাকতে৷ নাওয়া খাওয়া ভুলে, ছেলের সুস্থ্যতার জন্য কাঁদতে। আর কেউ নেই, ওর বাবা বা অন্য কোন আত্মীয় স্বজন ও ছিল না। অবকা হওয়ার মত বিষয় কিন্তু অবাক হওয়ার চেয়ে যে বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তিত সেটা ওর সুস্থ্যতা।
ওর আত্মীয় স্বজনের মধ্যে পরের দিন ওর মামা,ওর কাকী আর ওর বাবা আসল৷
আমি ওর মামাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফিরলাম। আমি যা করেছে তার জন্য পরিবারের সবাইকে দেখলাম যতেষ্ট আন্তরিক । ওর কাকী খুব আন্তরিক মানুষ৷ ভদ্রমহিলা কীভাবে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তা বুঝতে না পেরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিল জড়িয়ে ধরে।
বাসায় ফিরে আসি৷ কিন্তু মন পরে থাকে নিলয়ের কাছে৷ মামাকে ফোন করে ঘন্টায় ঘন্টায় খবর নেই৷ কিন্তু আমার মন ভরে না। সারাক্ষণ ভেতরে ওর জন্য ছটফট করে।
এদিকে হসপিটালে রোগীর চাপে দম ফেলানোর সুযোগ পাচ্ছি না। অন্য দিকে নিলয়ের জন্য মন কেমন করে।
বারো দিন পরে যেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল সেদিন একবার মনে হলো ওকে গিয়ে দেখে আসি৷ সন্ধ্যায় হসপিটাল থেকে ফিরে কিছু ফ্রুটস, আর কী মনে করে যেন কিছু ফুল নিয়ে গেলাম। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমাকে দেখে সবার মধ্যে অন্য রকম একটা চাঞ্চল্যতা খেয়াল করলাম৷ ওর কাকী,আম্মু ব্যস্ত হয়ে গেল আমার যত্নের জন্য৷ ওকে দেখলাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে৷ আমি সোফা থেকে উঠে ওর বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম। খুব শান্ত দেখাচ্ছিল ওকে, আমি কী বলব বুঝে না পেয়ে বললাম
-সুস্থ্য হওয়ার পর সারাদিন ফুটবল খেলতে পারবে তাই না?
নিলয় আবারো মুচকি হাসলো। ওর হাসিতে আমার মন মোমের মত গলে যাচ্ছিল। আমি আর এক মিনিট ও দেরি না করে বিদায় নিয়ে নিজের বাসায় আসলাম। হাতে এক গুচ্ছ ফুল ছিল, তা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। কী হচ্ছে আমার, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
সেদিন ঘুম থেকে জাগতে দেরি হয়ে গিয়েছিল৷ বিছানা ছেড়ে গোসল করে ব্রেকফাস্ট করতে বসব ঠিক সেই সময় নিলয় এসে ঢুকলো৷ ওকে দেখে আমার বুক ধুক ধুক করতে লাগলো। জমির কাকা দৌড়ে গেল
-আরে বাপজান! আফনি কি মনে করে আয়লেন?আমারে বললে ই হত৷ ছুইট্যা যাইতাম।
নিলয় হাতের বক্সটা দিতে দিতে বলল
-আম্মা করে পাঠিয়েছে ডাক্তার স্যারের জন্য। ওনাকে দিবেন৷
আমি দূর থেকে ওদের বার্তালাপ শুনছিলাম কিন্তু কিছু বলিনি। কী বলব বুঝে ও পাচ্ছিলাম না। নিলয় আড়চোখে আমাকে কয়েক বার দেখে চলে গেল।।
জমির কাকা টেবিলে খাবারের বক্স রাখতে রাখতে নিজে নিজে ই বলছিলো
-ভাল ছেলে। বড় ভাল ছেলে৷ এত ভাল একটা ছেলেটার কপালে আল্লাহ সুখ রাখে নাই।
আমি ব্রেকফাস্ট করতে করতে জমির কাকার বলা কথাগুলো ভাবছিলাম। কী কষ্ট ওর! কেন ই বা কষ্ট? এত সুন্দর একটা পরিবার আছে৷ মা,কাকী,কাকা, ভাই,মামা সবাই কত খেয়াল রাখে৷ তাহলে এত কষ্টের কী কারন থাকতে পারে?জিজ্ঞেস করব? না থাক।
সেদিন সারাক্ষণ আমি সেটাই ভাবছিলাম৷ কী হয়েছে নিলয়ের? কীসের এত কষ্ট?আগের চেয়ে তো সুস্থ্য ই আছে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ছাদে উঠলাম৷ অনেক দিন পর ছাদে৷ দক্ষিণ দিকে তাজা বাতাস আর অর্ধচন্দ্রের আলো মন্দ লাগছিল না।সেই সময় খেয়াল হলো নিলয়দের গেইট দিয়ে কেউ হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে৷ মুখে অসভ্য ভাষার গালি৷ মনে হচ্ছে নিলয়কে ই গালাগাল দিচ্ছে । গালি মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে৷ যে কেউ বুঝবে মাতাল একজন লোক যাচ্ছে?
কে এই মাতাল? এই ভাবে গালাগালি'র ই কী বা উদ্দেশ্য?
........চলবে...........…..
প্লিজ জলদি নেক্সট পার্ট দেন
ReplyDelete