গল্পঃ-অমাবস্যার চাঁদ
পর্বঃ-১ (ঘোলাটে আকাশ)
লেখকঃআরভান শান আরাফ
মরার পর কী হয়? মানুষ পঁচে যায়, নাকি ভূত হয়ে ফিরে আসে?
আট নয় বছর বয়সে ই এসব চিন্তা আমার মাথায় ঢুকে যায়। ছোট কাকার সাথে প্রায় পুকুরে গোসলে যাই। আমাকে ঘাটে দাঁড় করিয়ে ওনি সাঁতার কাটে।
কখনো রাত বিরাতে ওনার সাঁতার কাটার শখ জাগে৷ আমি আধো ঘুমে ওনার পেছনে পেছনে যাই। ছোট কাকা সাঁতরে মধ্যপুকুরে চলে যায়৷ আমি ঘাটের সিড়িতে ঝিম মেরে বসে বসে ভাবি৷ অনেক ভাবনা থাকে আমার। কখনো কখনো ভয় লাগে। আমি ছোটকাকাকে ডাকি-
-ছোটকা,ছোটকা। চল ঘরে যায়। আমার ঢর লাগে।
ছোটকা আমার কথা শুনে না। ভয়ে আমার কেমন যেন লাগে। মাঝে মধ্যে দু একটা শেয়াল ডেকে উঠে৷ ভয়ে আমার শরীর ঘেমে যায়।
এক সময় ছোটকা উঠে আসে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি
-আচ্ছা, ছোটকা-মরার পর কী হয়?
ছোটকা উত্তর দেয় না। হনহন করে হেঁটে যায়। আমি ভয় পেয়ে ওনার পেছন পেছন দৌঁড়ায়।
আমার যখন এক বছর বয়স তখন একদিন বাবা নিখোঁজ হয়ে গেল। বাবার শোকে মা হয়ে গেল পাগল। আমাকে দেখাশোনা করার মত তেমন কেউ নেই৷ ফুফুর বিয়ে হয়ে গেল। দাদা জমি জমা, ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। দাদির বেলা কাটে এত বড় বাড়ি দেখাশোনা করে। আমার খেয়াল রাখার দায়িত্ব পরল জয়তুন বানুর কাছে।
একদিন আমার মা বটি নিয়ে জয়তুন বানুকে তাড়া করেছিল। সেই থেকে তিনি ও আর আসেনি। তখন আমার বয়স তিন চার হবে। সারাদিন ছোটকার সাথে ঘুরি। ছোটকা আমাকে গোসল করিয়ে, খাবার খায়য়ে তার বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়াতো । সে অনেক আগের কথা। মা,বাবা উভয় হয়ে গেল ছোটকা।ছয় বছর বয়স থেকে ছোটকা কেমম জানি হয়ে গেল।আমি তখন স্কুলে যাই,মক্তব পড়ি৷ আশেপাশের ছেলে মেয়েদের সাথে খেলি৷ সব কেমন স্মৃতি হয়ে আছে।
আমার যখন আট নয় বছর বয়স। ছোটকা তখন ছাব্বিশ সাতাইশ বছরের তরুণ। দাদা ছোটকাকে বিয়ের জন্য কত জোর করল কিন্তু সে বিয়ে করবে না বলে যে পণ করলো তা ভাঙল না।
আমাদের এত বড় বাড়ি, এত সম্পত্তি অথচ খাওয়ার মত কেউ নেই। আমার পাগলি মা, এক রুমে বন্দি থাকে। দু বেলা জানালা দিয়ে হাশিম দাদা খাবার দিয়ে আসে। ঘর থেকে বের করলেই বটি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আমি বড় হচ্ছিলাম নিজের মত৷ পড়াশোনায় ভাল ছিলাম, এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান তাই বন্ধু বান্ধব তেমন ছিল না। আমি ও কারো সাথে মিশতে পারতাম না। স্কুল, বাড়ি এতটুকু ই আমার সীমানা।
একদিন খুব ভোরে কান্নাকাটির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ কচলে বের হতে দেখি মায়ের ঘরের দরজা ভাঙ্গা হচ্ছে৷ আমি জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম৷ ঘরের স্যালিং ফ্যানে আমার মা ঝুলছে। তার পায়ে লাল আলতা। সেই পা দুটি শূণ্যে দোলছে৷।
মায়ের সাথে আমার যেমন আনন্দের কোন স্মৃতি নেই তেমন কষ্টের ও। আজ মা আত্ম-হত্যা করল৷ আমার পাগলি মা, বুঝেনি যে তার বেঁচে থাকা না থাকা উভয় সমান৷ বরং মরে যাওয়াতে সে ও বেঁচে গেল সাথে অন্যরা ও। আমি কি বেঁচে গেছি?
সেবার সারাদিন আর বাড়ি ফিরি নি। হাঁটতে হাঁটতে পূবের বন পার হয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল আর বাড়ি না ফিরি।
বাড়ি ফিরলাম মধ্য রাতে। সারা বাড়ি তখন নিরব, নিস্তব্ধ। গেইট খোলা। মায়ের হয়ত দাফন হয়ে গেছে। একটু এগিয়ে যেতেই ছোট কাকা ছোট এলো। তার ভাবলেশহীন চেহারায় আজ আতঙ্ক। মনে হচ্ছিল সে কান্না করছে। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরল
তার স্নেহে আমার মন শান্ত হলো। দাদা,আসলো আরো খানিক বাদে। আমি তার দিকে তাকালাম না। সে আমার পাশে বসে দু একবার গলা ঝেড়ে বলল
-তোমার থাকা উচিত ছিল। এমনটা আর করবা না৷ তোমার বাবার মত স্বভাব হলে হবে না৷ তোমাকে বড় হতে হবে৷ মানুষ হতে হবে৷ আমাদের দেখতে হবে৷ তুমি ছাড়া আমাদের আছে ই বা কে।
বলতে বলতে ওনার কন্ঠ ভারী হয়ে এল। আমি খেয়াল করছিলাম আর একটু হলেই ওনি কেঁদে দিবে। আমি উঠে দাদীর রুমে চলে গেলাম। দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি বললাম
-দাদী,খিদা লেগেছে।
দাদী হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘরের দিকে ছুটল৷ আমি বিছানায় শোয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
সময় নদীর স্রোতের মত৷ অথচ আমার মনে হয় সেদিনের কথা। মেট্রিকের রেজাল্ট যেদিন দিল সেদিন স্কুলের হেডমাস্টার ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল
-গেল পঞ্চাশ বছরে ও এত ভাল রেজাল্ট কেউ করেনি।সারা বোর্ডের মধ্যে তুমি ফার্স্ট হয়ছে বাবা। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। ভাল করব জানতাম তবে এতটা ভালো করব আশা করিনি।
সেবার দাদা চারটা মহিষ জবেহ করে সারা গ্রাম খাওয়ালো। সাংবাদিক এলো, ইউনিয়ন চ্যায়ারম্যান,এমপি সবাই এসে হাজির।
ভর্তি হলাম শহরের সুনামধন্য কলেজে। কিন্তু সেখানে মন বসতো না। কলেজ হোস্টেলের বাধা ধরা নিয়ম, খাবার দাবারে আমার মন বিষিয়ে উঠেছিল৷ সেই সময় পরিচয় হয়েছিল তৈমুরের সাথে।
তৈমুরের কথা আমার খুব মনে পড়ে। ওর কোকড়ানো চুল, বড় বড় চোখ আর বাচ্চা বাচ্চা স্বভাব আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল অনেকগুলো বছর।
তখন সবে কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। একাকিত্ব আর গ্রামের পরিবেশ,ছোটকা আর দাদীকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।হোস্টেলের খাবার, রুটিন ভিত্তিক জীবন আমার অসহ্য লাগছিল। ঠিক সেই সময় একদিন ক্লাসে আমার বেঞ্চের পাশে বসে নাক খোটতে খোটতে ছেলেটা প্রশ্ন করছিল
-ফিজিক্সের স্যার কি ব্যাচ পড়ায়?
আমি একবার ফিরে তাকিয়ে উত্তর না দিয়ে নির্বাক হয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
তারপর একদিন সে গিয়ে আমাদের হোস্টেলে উঠল। ওর সাথে কখন থেকে বন্ধুত্ব,কখন আন্তরিকতা তার খেয়াল নেই। তবে মনে পড়ে ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত।
জীবনের প্রথম যৌনতার হাতেখড়ি হয়েছিল ওর সাথেই৷ গ্রীষ্মের ছুটিতে সে একবার বায়না ধরেছিল আমার গ্রাম ঘুরার৷ শহুরে ছেলে,কখনো গ্রাম দেখেনি ভেবে নিয়ে এসেছিলাম৷ সারাদিন পাড়াপাড়া ঘুরে, ফুটবল খেলে রাতে এক রুমে শুয়ে শুয়ে কত কথা ই না বলতাম। তেমন ই এক রাতে এক বিছানায় শুয়ে কথা বলার সময় তৈমুর আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।আমি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলাম৷চুমু খাওয়ার পর আমি তৈমুরের দিকে তাকালাম৷ ও ভাবলেশহীন৷ আমার সারা শরীর কেমন যেন করে উঠল। মনে হলো, খানিক চুমুর সময়টুকুতে আমি স্বর্গ সুখ পেয়ে গেছি৷
আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম৷ তৈমুর আবার আমার গলায় চুমু খেল৷ আমি কম্পিত হলাম৷ ওকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলাম৷ তারপর, সে আমার উপর চড়ে বসে আমার সারা শরীর চুমু খেতে লাগলো৷ আমি তখন উত্তেজনায় কাঁপছি৷ এক সময় একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়।
হোস্টেলে ফিরে যায়। এর পর থেকে আলাদা বিছানায় না ঘুমিয়ে দুজন একি বিছানায় ঘুমাতাম৷ আমার প্রতি ওর মায়া, টান আর ওর প্রতি আমার আবেগ আমাকে উন্মাদ করে রাখতো।রাতে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে রাখতাম৷ শরীরে হাত বুলাতাম। ঠোঁটে চুমু খেতাম৷
দুটো বছর খুব দ্রুত কেটে গিয়েছিল৷ইন্টারমিডিয়েট শেষে, যার যার বাড়ি চলে যায়। লম্বা সময় পর্যন্ত আমাদের কথা হয়নি৷
এইচ এস সি শেষে আমি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় আর তৈমুর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথম্যাটিকস।
পুরানো দিন গুলো স্মৃতি হয়ে গেল। কিন্তু প্রায় সময় আমার তৈমুরের কথা মনে হতো৷বাকি মেডিক্যাল লাইফে শুধু বন্ধু বলার মত তো অনেকে ই ছিল কিন্তু ওর মত কাউকে আপন করে পায়নি। ওর কমতিটা আমাকে আরো একা করে দিয়েছিল। কারো সাথে মিশতে পারতাম না৷ সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতে থাকতে লোক সঙ্গ অতিষ্ট লাগতো৷ পরিবর্তনটা আসলো ফাইনাল ইয়ারে ওয়ার্ডের সময়। রোগীর সাথে মিশে,কথা বলে সেই সঙ্গভিতী কিছুটা দূর হলো।
জীবন থেমে থাকে না৷ মা বাবা ছাড়া সম্পূর্ণ একা বড় হওয়া একজন মানুষ আজ ডক্টর।
গ্রামে আর তেমন যাওয়া হয়নি। দাদা,দাদী মারা গেল বছর দুয়েক হবে। ছোটকা আছেন, সব দেখাশোনা করেন৷। গত দুদিন আগে এসেছিলো। বাড়িতে নতুন দালান উঠিয়েছে৷ নতুন চারটা,ট্রাক্টর কিনেছে৷ এসব শুনতো ভাল লাগে না৷ আমি ছোটকাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলাম৷ মনে হয় এই পৃথিবীতে আমাদের মত একা কেউ নেই। ছোটকা সান্ত্বনা দিয়ে, হাতে লাখ খানেক টাকা ধরিয়ে চলে গেল৷
ড্রয়ার ভর্তি টাকা। এত টাকায় করব কী? হসপিটাল থেকে দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকি। দুজন চাকর আছে। তারা ই সব কিছু করেন৷ টাকা খরচের কোন উপলক্ষ নেই, কোন শখ আসে না মনে। জীবন যেন কোথাও আটকে আছে।
চেম্বার থেকে ফিরে গরম পানি দিয়ে গোসল করে বিছানায় শোতেই আমার পি.এর ফোন।ইমার্জেন্সি, হসপিটাল যেতে হবে।
আমার বিশ্রাম নেওয়া হলো না৷ বের হলাম হাসপাতালে'র জন্য।
হাসপাতালে ঢুকতেই রোগীর আত্মীয় স্বজন ছুটে এলো। বুঝা ই যাচ্ছে সবাই আতঙ্কিত। আমি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি, ১৭/১৮ বছরের একটা ছেলে শোয়া। সেন্স লেস। ইনজেকশন পুশ করার মিনিট দুয়েক পরে জ্ঞান ফিরলো।একজন মহিলা গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিল। আমার মনটা বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেলো। অন্যের কষ্টে খুব কম মন খারাপ হয় আমার। কিন্তু আজ কেন যে মন খারাপ হয়ে গেল৷ আমি ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকালাম। বড় বড় কালো দুটি চোখ, ঘন জোড় ভ্রু, কুকড়ানো চুল,খাড়া নাক। দেখলে মনে হয় কোন দেবকিশোর৷ চেহারাতে একটা অন্য রকম মায়া৷ একটা অন্য রকম অনুভূতি। ওর চেহারাটা কার সাথে যেন খুব মিল। কার কথা যেন মনে করে দিচ্ছিলো। আমি যখন ওর দিকে তাকিয়ে অতীতের কোন একজনের চেহারা খোঁজে বেড়াচ্ছিলাম তখন সে আমাকে ডাকলো
-ডাক্তার সাব! এদিকে আসেন তো একবার৷
আমি বিস্মিত হলাম। প্রেশেন্ট ডক্টরকে ডাকতেই পারে কিন্তু যে প্রেশেন্ট একটা মাইনর হার্ট এট্যাক থেকে মাত্র জ্ঞান ফিরে তাকালো সে এভাবে ডাকবে কেন?
আমি কাছে গেলাম।
-তুমি কথা বলছ কেন?চুপ করে শোয়ে থাকতে পারো না?
-বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকব৷ আগে বলুন আমার শরীর ঠিক আছে কিনা?
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম
-নাহ, ভাল নেই৷ সপ্তাহ খানেক থাকা লাগবে৷
ছেলেটা চোখ মুখ উলটে বলল
-তাহলে আমার এক্সাম?
-আগে বাঁচো তো৷ এক্সাম পরে দেওয়া যাবে৷
আমি নার্সকে সব বুঝিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম তখন রাত অনেক।
আমার একাকিত্বের জীবনের ভয়াবহ শূণ্যতা আর বুক ভর্তি যন্ত্রনা দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের চেহারাটা মনে করতে লাগলাম।কিন্তু মনে পড়েনি৷ ভুলে গেছি সব৷ শুধু চোখে ভেসে উঠল দু খানা আলতা মাখা পা।
......(চলবে)......
শেষ টা ঠাস করে হয়ে গেল!মজা পাইনি
ReplyDeleteএখানে আসি শুধু মাত্র তোমার গল্প পড়ার জন্য
ReplyDelete