গল্পঃঅর্ধনর
লেখকঃআরভান শান আরাফ
সেদিন দুপুরে৷ গ্রীষ্মের গরমের অন্ত ছিল না।আমি কলেজ থেকে ঘেমে নেয়ে বাসায় ঢুকতে খেয়াল হলো পথের দাঁড়ের কড়ই গাছে গাই বাধা৷ তার সামনে এক গামলা খড় আর কিছু খৈল।এক সপ্তাহ বাড়ি ছিলুম না, এর মধ্যে গাই এলো কোথা থেকে? আমি মাকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি মা রান্না ঘরে।রান্না ঘর থেকে ই জবাব দিল
-ছোটন এলিরে? এদিকে আয় বাপ
রান্না ঘর তখন ধোয়াতে একাকার। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
-সে কি মায়ো, তোমারে না কইছিলাম গ্যাসে রান্তে৷ গ্যাস কয়?
মা অনেকটা অপরাধীর ভঙ্গিতেই উত্তর দিল
-রাগ করিছ না বাপধন। গ্যাস শেষ হয়ে গেছে৷।
-বড়দারে দিয়ে আনালে ই পারতে৷
-তর বড়দা সারাদিন কত কাজ করব?পোলাডার সারাদিন অবসর আছে?
-বাজান কয়?
-তর বাজান পূব পাড় গেছে।
-গাই কার?
-তর বাজান কিনছে। অহন তুই যা, কাপড় খোলে ডুব দিয়ে আ গিয়া৷ আহারে! আমার বাপধনটা ঘাইম্যা শেষ।
রান্না ঘরেই মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে কাপড় না খোলে ই বাঁশ বনের দিকে হাঁটা দিলাম৷ আমি জানি সেখানে একজন আমার জন্য রোজ অপেক্ষা করে।আমি আসব না জেনে ও বসে থাকে৷আমার প্রতি তার অদ্ভুত টান৷ তার প্রতি ও আমার। সপ্তাহের এক দুইটা দিন আমি কলেজ হোস্টেল থেকে বাড়িতে ছুটে আসি কেবল তার টানে৷ এই টানের নাম নেই৷ নাম দিতে গেলে জাত,সমাজ,ধর্ম পায়ে বেড়ি দিয়ে দিবে৷
ওর নাম নিত্য। বাবা মা শখ করে নাম রেখেছিল নিত্যানন্দ। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, কোমল শরীর,দীর্ঘ আখি পল্লব৷ আর মেয়েদের মত চিবুক।ওকে কেন জানি ভাল লাগে৷ আমি শখ করে বউ বলে ডাকি৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে যখন ফিসফিস করে বউ বলে ডাকি তখন ওর খিলখিল হাসি আমাকে মুগ্ধ করে৷
সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কিশোর নিত্য৷আমি বনের পাখিকে বুকের খাঁচায় যত্নে আগলে রেখেছি। একটা ছেলে হয়ে ছেলেকে ভালবাসি। কেন বাসি তা জানি না, তবে ওর শরীর আমাকে টানে।ওর কোমড়,স্তন,নিতম্ব ছাড়া ও অধিক টানে ওর মিষ্টি চেহারাটা আর দুটি চোখ।
গ্রামের আট দশটা ছেলের মত না নিত্য৷ সে একটু অন্য রকম। একটু মেয়েলি৷ গ্রামের লোকেরা হিজড়ে বলে গালি দেয়, অবহেলা করে৷ ছেলেরা এড়িয়ে চলে, ক্ষ্যাপায়।নদীতে গোসলে গেলে,বাজারে গেলে অথবা খেলার মাঠে। সবাইকে দেখেছি ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে৷ শুধু আমার কাছে ই একদিন মনে হলো ছেলেটা আমাকে কামনা করে৷
একদিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফেরার পথে খেয়াল হলো নদীর ধারে হিজল গাছের গোড়ায় বসে বুক ফাটিয়ে কান্না করছে। আমি কাছে যেতেই কান্না থামিয়ে চলে যাচ্ছিল৷ আমি হাত টেনে ধরে আটকে জিজ্ঞেস করলাম
-কিরে নিত্য, কে বকল তরে?
-কেউ না জীবন দা৷
-না বকলে সইন্ধ্যা বেলা কাঁদিস কেন?
নিত্য আমার পাশে বসল। আমি ওর একটা হাত নিয়ে আমার দু হাতের মাঝে রাখলাম৷ নিত্য আশ্বস্ত হল৷ চোখ মুছে বলল
-আচ্ছা, জীবন দা -সবাই আমায় এত অবহেলা করে কেন গো? আমি কি মানুষ নয়? ঠাকুর আমায় এভাবে গড়ল, এ কি আমার দোষ? আমি ঠাকুরকে বলি নাই তো৷ জীবন দা গো, এ জীবন বড় তেক্ত লাগে আজকাল।ইচ্ছে করে এই নদের জলে ডুবে মরি অথবা হিজলের ডালে ঝুলে প্রাণ দিয়া দেয়৷ ঘরে,বাহিরে, সর্বত্র জ্বালা৷ এই জ্বালা আর সহ্য হয় না।
নিত্যের কথাগুলো আমার মনে আঘাত করলো। আহা! কি করুণ ওর মুখখানা৷ মায়ার রাজ্য ও সেই মুখশ্রীতে। আমি কপাল টেনে আবেশে গলে গিয়ে চুমু খেয়ে বললাম।
-মন খারাপ করিস নে নিত্য৷ সব ঠিক হয়ে যাবে।।
সেদিন তো বলেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি। ছেলেটা যেন আরো একা হয়ে যাচ্ছে৷ আমি সময় দিতে পারছিলাম না৷ একটু ভাল ফলাফল করতে কলেজ হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। সপ্তাহে দু দিন বাড়ি যেতাম নিত্যকে দেখতে৷ ওকে আদর করতে৷আমাকে ছাড়া ছেলেটা কেমন শুণ্য হয়ে যেত।আমাকে দেখলে যেন ওর জীবন আনন্দে ভরে উঠতো৷
বাড়ির উত্তর দিকের বাঁশ বাগানের পেছনে আমরা বসতাম। নিত্য আমার কুলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গল্প করত৷ আমি ওর অল্প ফুলে ওটা স্তনে হাত বুলাতে বুলাতে ওর কথা শুনতাম৷কখনো রাতে আমাদের দেখা হতো বাঁশ বাগানে৷ সেদিন আমরা মিলিত হতাম৷ ওকে কখনো ছেলে মনে হয়নি আমার। মনে হতো একটা মেয়ে পুতুল। যাকে মন ভরে আদর করা যায়৷ যার শুধু যোনিটা ই নেই, বাকি সব সুনিপুণ ভাবে গড়া৷লোকে ওকে হিজড়া বলে কিন্তু আমি দেখতাম অপূর্ব এক কিশোরী।যার মনের পবিত্রতা,শরীরের স্নিগ্ধতা আমাকে ঘর ছাড়া করে।
নিত্যের সাথে আমার সম্পর্কটা সমাজের চোখে কাঁটার মত বিধলো। ফাইনাল ইয়ারের পরিক্ষা প্রায় শেষ৷ বাড়িতে যায়নি দু মাস৷ কেমন আছে নিত্য জানি না৷ এর মধ্যে দাদা এসেছিল কিন্তু কিছু বলতে পারিনি৷ আগামী কাল পরিক্ষা শেষ হবে৷ আমি নিত্যকে দেখব, ওকে আদর করব ভাবতেই ভাল লাগছিল।
পরিক্ষা শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। আমি ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনের জন্য স্টেশনে এসে দাঁড়ালাম। ট্রেন আসতে আরো আধা ঘন্টা।ট্রেন দিয়ে বাড়ি যেতে চল্লিশ মিনিটের মত লাগে।
আমি প্ল্যাটফর্মে বসে বসে পত্রিকার হেডলাইন গুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলাম।হঠাৎ হৈ চৈ করে কিছু হিজড়ে এসে রাস্তার লোকদের কাছে টাকা চায়তে লাগলো। ঠিক সেই সময় আমার চোখ আটকে গেল হিজড়াদের ভিড়ে অতি-পরিচিত একটা মুখ দেখে।
ওর পড়নে লাল শাড়ি,হাত ভর্তি চুড়ি,কপালে টিপ,উন্মুক্ত কোমড়। আমার মনে হলো, মানুষটাকে আমি চিনি৷ খুব চিনি৷ দম বন্ধ হয়ে এলো। এ কি নিত্য? হ্যা নিত্য ই তো৷ ঐ চোখ, ঐ খিলখিল হাসি, হাটার ধরন।। ওর এ রূপ কেন?
আমি যখন ওপাড়ের রাস্তায় যেতে উঠে দাঁড়ালাম ঠিক তখন ঝকঝক করে ট্রেন এসে দাঁড়ালো। আমি প্ল্যাটফর্ম ঘুরে রাস্তায় যেতে যেতে তাদের আর পায়নি।
ট্রেনে চড়ে বসে মনটা ব্যথায় ভার হয়ে এলো। কী হলো ছেলেটার? শেষ অবধি তাকে এই কঠিন পথে পা রাখতে হলো? নিত্য! আমার নিত্যানন্দ!!
বাড়ি ফিরে সোজা নিত্যদের বাসায় গেলাম৷ তাদের বাড়িতে তালা।পাশের বাসার কাকীমা আমাকে দেখে কেমন আড়চোখে তাকালো৷ আমি ওনাকে কিছু না জিজ্ঞেস করে বাড়ি ফিরে মাকে ধরলাম। মা কিছুটা উদাস ছিল৷ আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল
-কিরে বাজান,পরিক্ষা কেমন দিলি?
-পরিক্ষা তো ভালই হয়ছে৷ কিন্তু গ্রামে কি হয়ছে?
মা কিছুটা উদাস সুরে ই বলল
-হেই কথা পরে হুনিছ৷ এখন যা, মুখ হাত ধুয়ে খেতে আয়৷
-না, অহন কওন লাগবো।
মা আমার পাশে বসে বলল
-বিমলের পরিবারকে এলাকা থেকে বের করে দিল। পোলাটারে ও পিটিয়ে মেরে ফেলছিল। তর দাদা গিয়ে বাঁচায়লো।
-কেন মা?
-তরে আর নিত্যানন্দকে নিয়ে কথা উঠলো। ঐ পোলায় নাকি হিজড়ে৷ তুই নাকি হেরে...
মা জিভ কামড়ে ধরে থেমে গেলো৷ আমার সারা শরীর ঝনঝন করে উঠলো। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
বিকেল বেলা সারা এলাকা ঘুরে বেড়ালাম। কতজন কতভাবে তাকালো।নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো,আমি কোন একটা খুন করে ফেলেছি।লজ্জায়, রাগে গ্রামে থাকতে মন চাচ্ছিল না।
আশে পাশের দু তিনটা হিজড়ে পল্লীতে খোঁজ করে ও নিত্যকে পাইনি।আমার রাতে ঘুম হতো না, খেতে ইচ্ছে হত না, মন ভেঙ্গে গিয়েছিল৷
একদিম সন্ধ্যা লগ্নে নদীর পাড়ে বসে ছিলাম। ঠিক সেই সময় বড়দা পিছন থেকে এসে পাশে বসলো। আমি একবার ফিরে তাকিয়ে আবার নদীর দিকে উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে ছিলাম। দু তিন মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর দাদা কথা বলল
-নিত্যান্দের জন্য মন খারাপ?
আমি কিছু না বলে দাদার দিকে তাকালাম।দাদা আমার কাধে হাত রেখে বলল
-শুন ভাই, আমি জানি তোর মনের কথা। তুই নিত্যকে পছন্দ করিস সেটা ও বুঝতে পারি কিন্তু সমাজ বলতে একটা কথা আছে। তুই শিক্ষিত, তোর বুঝা উচিত, নিত্য কোন মেয়ে না৷সৃষ্টিকর্তা ওরে অসম্পূর্ণ করে গড়েছে৷ একজন অসম্পূর্ণ মানুষকে হয়ত ভালোবাসা যায় কিন্তু সেই মানুষটাকে নিয়ে সমাজে সংসার করা যায় না। দু দিন পর আমি চলে যাব ঢাকায়৷তখন তর খেয়াল রাখতে হবে মা-বাবার৷চেষ্টা করিস,বাপজান যে সম্মান নিয়ে এই গ্রামের প্রধান হয়ে আছে সেই সম্মান যেন টিকে থাকে
বড়দা একজন গণিতের প্রফেসর হয়ে আমাকে সমাজ শিখিয়ে চলে গেলো। যার প্রতিটি কথা সত্য মনে হচ্ছিলো কিন্তু আমার মন তা মানতে নারাজ৷ নিত্য কোথায় আছে, কেমন আছে জানার জন্য আমার মন কেমন করছিল৷ আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি।
সন্ধ্যা নামলো।আমি ঘরের দিকে পা বাড়ালাম৷ সেখানে আমার মধ্যবয়সী মা, আমার জন্য যার সমুদ্র সম ভালোবাসা, আর আমার বাবা, যারা সম্মানে এলাকার প্রতিটি মানুষ কুর্ণিশ করে। আমাকে তাদের জন্য ঘরে ফিরতে হবে। নিত্যকে ভুলে, নতুন জীবনের সূচনা করতে হবে৷ তাকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা বৃথা। কারন সে অর্ধনারী অথবা অর্ধনর।সে অসম্পূর্ণ আর এ সমাজ অসম্পূর্ণ কিছুই পছন্দ করে না।
মন বিষাদে ভরে উঠল৷ আহা! নিত্য৷ আমার নিত্য। ভগবান কেন তোমায় নারী করে গড়লো না।
চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল৷ এই অশ্রু জলের কোন মূল্য নেই৷ আমি শূণ্যতায় কাটিয়ে দিব আজীবন
..........(চলবে).......
No comments: