ফাগুনের বিলাপ
আরভান শান আরাফ
সৌবীর,কতকাল কথা হয় না। অর্ধ যুগ হয়ে যাবে তোমাকে দেখি না৷ ইদানীং দেখতে ও ইচ্ছে করে না।ভুলতে বসেছি তোমার চেহারাটা। শত চেষ্টা করে ও তোমায় মনে রাখতে পারছি না৷ অথচ এমন কিন্তু কথা ছিল না৷ ইচ্ছে ছিল সারা জীবন তোমার সাথে কাটিয়ে দিতে অথচ নিয়তির কি অদ্ভুত লীলা, আমাকে সময় কাটাতে হচ্ছে একা৷ নিসঙ্গ হয়ে, কেরেলার আদিমালি নামের সম্পুর্ণ ভিন্ন এক শহরে।যেখানে সকল মানুষ অপরিচিত৷ ভাষা,ধর্ম আর সংস্কৃতির দিক দিয়ে উন্নত এক সভ্যতার ভিড়ে নিজেকে কেমন জানি ঘর ভাঙ্গা পলাতক বালকের মত লাগে।
সৌবির, তোমার বড় ইচ্ছে ছিল না আমাকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরার? এই দেখো আমি দেশে দেশে ঘুরি ফিরছি। তবে তুমিহীন৷ শুণ্যতায়,নিসঙ্গতায়।
গত দু দিন ধরে টানা বৃষ্টি। তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রীতে নেমে গেছে। গত পরশু মুন্নার হয়ে আদিমালিতে এসেছি। সেদিন ই পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দেওয়ার সময় বৃষ্টির আনাগোনা ছিল। কে জানত যে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টিতে আটকা পড়ব?ভাল লাগে বৃষ্টি৷
সৌবীর, তোমার তো বৃষ্টি পছন্দ ছিল। বরং আমার ই পছন্দ ছিল না। বর্ষা আসলে সারাক্ষণ বিরক্ত হয়ে বসে থাকতাম। একবার টেনে বৃষ্টিতে ভিজাতে গিয়ে ধমক খেয়েছিলে। সেদিন তোমার ছলছল চোখ দেখে মনে মনে শপথ করেছিলাম আর কোন দিন তোমাকে ধমক দিব না। তোমাকে মানাতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে টানা দু দিন জ্বর সর্দিতে ভোগে ছিলাম৷ আর আমার সেবা করতে গিয়ে তুমি অসুস্থ্য,কৃশকায়। সৌবীর,এখনো মনে পড়ে সেই দিন গুলোর কথা।
গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে আল্লু মাদনি নামের মেয়েটা এসে খাবার দিয়ে গেল। নারিকেল তেলের গন্ধে কিছুই মুখে দিতে পারিনি৷ বাঙলার ভাত মাছ খেয়ে বড় হওয়া ছেলের মুখে এসম খাবার রুচে না। বাধ্য হয়ে দুটা কলা আর নাড়ু খেয়ে সারাদিন কাটালাম। খানিকবাদে আমি ই যাব রান্না করতে। ইদানীং প্রয়োজনে রান্নাটা ও শিখে নিচ্ছি।
ঐদিন, মুন্নারে যখন ছিলাম সেদিন পাহাড়ের আড়ালে এক প্রেমিক যুগলকে চুমু খেতে দেখে মন ভরে গিয়েছিল। মনে হল এই মানুষ দুটি সুখি।জগতের সকল নিয়ম, আইন উপেক্ষা করে তারা সুখি। অথচ আমরা ই কেবল সুখি হতে পারিনি। এতে ভালবাসার পরে ও নিয়তি আমাদের পক্ষে ছিল না। বড় অদ্ভুত এই নিয়তি।
গতকাল রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে ই আমার এমন হয়।ঘুম থেকে জেগে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। শীত শীত লাগছিল, তাই চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিতে ই মনে হল -এই চাদরটা তোমার দেওয়া। সেদিন সন্ধ্যায় হুট করে তুমি চাদর নিয়ে হাজির। সবুজ পাতার মত উলের তৈরি চাদর দেখে আমি অবাক। এত শীতের জামা থাকতে হঠাৎ চাদর দেওয়ার কারন জানতে চাওয়ায় শুনালে চাদরের অনেক গুন। আমি চাদরের গুণে মুগ্ধ না হয়ে তোমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম৷ সত্য সৌবীর, তুমি খুব জানতে। জানতে বলে ই হয়ত আমাদের বিচ্ছেদ হল। একটু কম জানাটা ও মন্দ ছিল না তোমার জন্য।
তোমার আর আমার দেখা হয়েছিল ট্রেনে। আমার নামার কথা ছিল মৈন্দ স্টেশনে। কিন্তু ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে গেল খেয়াল ই করিনি। ঘুম ভাঙল সম্পুর্ণ অচেনা এক কন্ঠস্বরে৷ আমি চোখ খোলে দেখি বিশ বাইশ বছরের এক ছেলে আমার পাশে বসে বাদাম ওয়ালার সাথে দুটা বাদাম বেশি দেওয়ার অনুরোধ করছে৷ বাহিরে তাকিয়ে দেখি ট্রেন আমার স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে। মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল লাফ দিয়ে নেমে যায়। নিজের করা ভুলের রাগটা গিয়ে পড়ল তোমার উপর। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে বলল
-বাদাম কি জীবনে খাওনি নাকি?
তুমি খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলে
-নাহ৷ খাইনি৷
বলে বাদামের ঠুঙ্গাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে
-নেন, বাদাম খান।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ট্রেনের সীট থেকে উঠে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালাম। সামনের স্টেশনে নেমে ফিরে যেতে হবে।
বাসায় ফেরার পর আমি টানা দু দিন তোমায় স্বপ্ন দেখলাম। কত অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন।
বাবা মা মারা যাওয়ার পর এত বড় বাড়ি,সম্পত্তি সব কিছু দেখা শোনার জন্য বড় মামা চলে এল৷ আমার বয়স তখন বারো।কাকারা সবাই দেশের বাহিরে৷ বছরান্তর একবার করে এসেছে আর বারবার আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু চিরকালের ঘরকুনো ছেলে ছিলাম। মৈন্দ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করেনি। অথচ আজ দেখো দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
সৌবীর, আমাকে করা তোমার প্রথম চুম্মনের শব্দ আজো আমার কানে চির প্রিয় শব্দ হয়ে বাজে। আমাদের দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল নীলকান্তপুরে৷ আমি গিয়েছিলাম বন্ধু ভুবনের বিয়েতে। সেই বিয়েতে তুমি ছিলে কনে পক্ষের। বিয়ের সময় বর বধূ যখন সাত পাক নিচ্ছিল, পুরোহিত যখন মন্ত্র পড়ছিল তখন দেখলাম তুমি হলুদ পাঞ্জাবিতে দাঁড়িয়ে। তখন চিনতে পারিনি। ঢোলের তালে তালে যখন নেচে নেচে ঘাম ঝড়াচ্ছিলে তখন মনে পড়ল যে, ছেলেটাকে আমি চিনি।
ডেকে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। সত্য বলতে কি সেই দিনের জন্য একবার ও মনে হয়নি যে এই ছেলেটা একদিন আমার সব কিছু নিয়ে নিবে।আমার ভেতর বাহির, সবটা জুড়ে কেবল তার ই বাস হবে।
ঐদিন হাঁটতে হাঁটতে কবরের দিকে গিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম মনে নেই তবে স্থানীয় লোকেরা জায়গাটাকে মৃতুকোনী বলে ডাকে। চারদিকে সারি সারি গাছ। মাঝখানে ইট পাথরের কবর। হলুদ ফুলে ঢেকে আছে। চোখে ধাঁধা লেগে যায় এমন হলুদ। সূর্যের আলো লেগে ফুলের পাপড়ি চিকচিক করছিল। আমি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কাছে যেতে ই মনে হল হল কৃত্রিম ফুল। বুকটা বিষাদে ভরে গেল। মনে হল মৃতদের সাথে ঠাট্টা করা হচ্ছে।।
পরের দিন অনেক গুলো গোলাপ কিনে খুব ভোরে একেকটা কবরে দিতে দিতে মনে হচ্ছিল আমি যেন তোমার চক্রে বাধা পড়ে গেছি৷ বের হতে পারছি না সেই চক্র থেকে।
নীলাকান্তপুরে আমার অনেক বার যেতে হয়েছিল শুধু ভুবনের খাতিরে৷ যতবার সেখানে গিয়েছি ততবার তোমার সাথে দেখা হয়েছে। কথা হয়নি। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি বারবার আর তুমি চিনতে ই পারুনি। তারপর কথা হল একদিন শীতের ভোরে। চাদর জড়িয়ে খাল পাড়ে পাখি শিকার করছিলাম। ঠিক সেই সময় কোথা থেকে ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে আমার বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে বলেছিলে,পাখি খাওয়ার জন্য না৷ খাওয়ার জন্য হাঁস মুরগি আছে। রাগে ঐখানে ই তোমাকে ঘুষি মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল। রাগ থামানো কষ্টকর ছিল তবু নিজেকে সামলে ঘরে ফিরে এলাম। চৌধুরী বাড়ির ছেলেদের এমন অপমান সহ্য করার কথা নয়৷ কিন্তু আমি সহ্য করে নিলাম।
সৌবীর,সেদিনের আমি খুব দ্রুত পালটে গিয়েছিলাম যেদিন শুনলাম এই বিশ বাইশ বছর বয়সে ই তোমার করা অসাধ্য কাজগুলোর কথা। সত্য বলছি, যে ভাল না লাগাটা ভেতরে ঘর সংসার বেধে রেখে ছিল সেটা খুব দ্রুত ভাল লাগায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
নীলকান্তপুর থেকে মৈন্দ ততটা দূরের পথ নয়। আমি নানান বাহানায় ছুটে যেতাম। তোমার সাথে খুব দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মধ্যে তিন চার বছরের যে সময় ব্যবধানটা ছিল তা কখনো আমাদের বন্ধুত্বের সামনে এসে দাঁড়ায়নি।
সেই বন্ধুত্ব একদিন আবেগে রূপ নিল।সিলেট থেকে ফেরার পথে মাইক্রোবাস উল্টে পা ভেঙ্গে বিছানায় ছিলাম তিন মাসের ও অধিক সময়৷ সেই সময় টা আমি আবিষ্কার করেছিলাম অদ্ভুত এক মানুষকে। ক্লাস,টিউশন সব অফ করে মৈন্দ এসে পড়েছিলে শুধু আমার সেবার জন্য। সৌবির,যেদিন তুমি ব্যাগ নিয়ে আমার রুমে ঢুকে বলেছিলে, তুমি আজ থেকে এখানে থাকবে, সেদিন কেন জানি প্রথমবারের মত মনে হয়েছিল ইশ্বর আছেন৷ আর তিনি জাগ্রত।
এই যে বৃষ্টি নামতে শুরু করল আবার। কিছুক্ষণ আগে ও থেমে গিয়েছিল৷আমার রান্না বসানো দরকার। খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু আমার খেতে হবে। কাল একটা কনফারেন্স আছে। আমাকে সেখানে যেতে হবে ভোরে।একটা সময় ছিল যখন ভোরে ঘুম থেকে জাগাটা আমার মত ছেলের জন্য মৃত্যু স্বরূপ ছিল কিন্তু এখন তো ভোর হতে না হতে ই জেগে যাচ্ছি। আজ ভোরে যখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল তখন ছাতা নিয়ে বের হয়ে ছিলাম।এই অঞ্চলের গাছের পাতা যেন একটু বেশি ই সবুজ৷ নিকটে ই পাহাড়৷ একটু দূরে ঝর্ণা৷ রাত বাড়লে সেই ঝর্ণার শব্দ কানে আসে৷ আমার মন তখন কেমন জানি করে৷ তোমাকে বুঝানো যাবে না।
একটা দীর্ঘ সময় তোমার সাথে কাটিয়েছি৷ প্রেমে মুগ্ধ হয়ে আনন্দে ভেসে ছিলাম। দিন গুলো খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। একটা সময় আমি সুস্থ্য হয়ে উঠি। তোমার সাথে কাটানো দিনগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যখন শুনলাম তুমি চলে যাবে সেদিন ভেতরটা কেমন করে উঠল। মন চাচ্ছিল তোমায় আটকায়। কিন্তু আটকানোর কোন উপায় জানা ছিল না সম্পর্ক টা তখনো ছিল নামহীন৷ শুধু বন্ধুত্ব নামের সম্পর্কে এত জোর খাটানো যায় না৷
তুমি চলে যাওয়ার পর দু দিন নিজেকে মানানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বারবার কেবল তোমার কথা ই মনে হচ্ছিল। তোমার এখানে কাটানোর দিনগুলো চোখে ভাসছিল। সকালে যখন ব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে এসে বলতে -উঠুন,ব্রাশ করে নাস্তা করবেন৷ আমি তখন বাধ্য ছেলের মত তোমার কথা শুনে নিতাম। বিকালে তোমার কাধে ধরে হাঁটার সময় অথবা সন্ধ্যায় দুজন যখন বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় বসতাম কিংবা রাতে যখন শখ করে নিজে মুখে খাবার তুলে খাওয়াতে তখন সেই সময় গুলোকে ভুলতে প্রাণের স্নায়ু ছিড়ে যাচ্ছিল।
আমি থাকতে পারিনি সৌবির।একদিন সারা রাত জেগে তোমার কথা ভেবে যখন একটু ও ঘুম হয়নি সেদিনের ভোরে ছুটে যায় নীলকান্তপুরে।
সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম যে, আমি তোমাকে ঠিক কতটা চাই৷ ট্রেনে দেখা হওয়া একজন অযাচিত ব্যক্তিকে এত গভির ভাবে ভালবেসে ফেলব সেটা চিন্তা ও করতে পারিনি।
তুমি ও কি আমায় ভালবাসুনি?ভাল ই যদি না বাসতে তবে সেদিন আমাকে দেখে আবেগে তোমার চোখে জল এসেছিল কেন?ভাল ই যদি না বাসতে তবে ঐদিন রাতে আমাদের মিলন হল কেন? ঐদিন রাতের পর যতবার আমাদের মিলন হয়েছিল ততবার তোমার চোখে সুখ দেখেছি৷ কিন্তু কে জানত? সেই তুমি একদিন বিলীন হয়ে যাবে৷
কিছু দিন আগে টুকটাক কেনাকাটার জন্য বাজারে গিয়েছিলাম৷ পাহাড়ের উপর বাজার৷ সেখানে একজন মহিলা বাতি বিক্রি করছিল৷খুব সুন্দর করে মাটি দিয়ে বানানো বাতি৷আল্লু মাদনি টুকটাক হিন্দি জানে। আমি মালায়লাম ভাষা জানি না৷ তাই তার সাথে সেই টুকটাক হিন্দিতে ই কথা বলতে হয় । আমি তাকে বাতি কেনার কথা বললাম৷বাতি বিক্রেতাকে খুব খুশি মনে হল। আমি তার কিছু ছবি তুলে নিলাম। সে হাসি হাসি মুখে স্পষ্ট বাংলায় বলল
-তুমহি বাঙালি আছ নাকি?
আমি অবাক হয়ে বললাম
-হ্যা। আপনি বাংলা জানেন?
-না নাগে গুট্টিলা
আমি বুঝতে না পেরে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম৷ ওনি আমার অপারগতা বুঝতে পেরে বলল
-মোই বাঙালা না জানি। মুই কোলকাতা কেলাসা করতুম।
-কেলাসা?
-ওয়ার্ক।
আমি গভীর ভাবে খেয়াল করলাম,কন্নড় ভাষায় কথা বলা একজন সাউথ ইন্ডিয়ান মহিলা খুব আপন স্বরে আমার সাথে কথা বলছে। তার চোখের গাঢ় কাজল,হাতের কাচের চুড়ি আর নাকের নথ আমাকে বারবার মৈন্দের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল৷ অথচ আমি সব কিছু ভুলতে চাচ্ছি৷ ভুলতে চাচ্ছি সকল স্মৃতি,সকল মোহ৷আমাদের মৈন্দে এমন ই একজন মহিলা ছিল৷ আমরা তাকে জেঠাইন বলে ডাকতাম। রোজ সকালে ঝুড়ি ভর্তি খাবার নিয়ে আসত৷ আজ এত দিন পর সেই মহিলার কথা মনে হচ্ছিল৷
সৌবির, এখানে আর বেশি দিন থাকব না৷ পরের গন্তব্য কলকাতায়। জানি না সেখানে আর কতদিন থাকব। এই ভেসে বেড়ানোটা মন্দ লাগছে না। হয়ত ব্যস্ততায় তোমাকে ভুলতে পারব৷ খুব অদ্ভুত জীবন আমার৷ ছেলে বেলা মা মাকে হারিয়ে নিজের মত করে বড় হচ্ছিলাম৷ হুট করে ই জীবনে তুমি এলে। ফাগুনের পুষ্প যেমন সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলে শীরের রুক্ষ প্রকৃতিকে, ঠিক তেমন ভাবে তোমার আগমন আমার জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল। অথচ ইশ্বরের ইচ্ছে ছিল ভিন্ন। ইশ্বর হয়ত চায়নি আমি তোমাকে নিয়ে সুখি হয়। আমাকে সারা জীবন একা বাঁচিয়ে রাখার ইশ্বরের এমন নিখুঁত পরিকল্পনার বিন্দু পরিমাণ টের পেলে তোমায় ভালবাসতাম না। কাছে টানতাম না তোমায়।
গভীর রাত। পাহাড়ি ঝিঁঝি পোকার ডাক,ঝর্ণার শব্দ আর হৃদয়ের ব্যাকুলতা মিলে মিশে একাকার। আদিমালিতে আজ আমার শেষ দিন৷ আগামীকাল কেরেলা ছাড়ব কলকাতার উদ্দেশ্যে। দেড় মাস কেরেলায় ছিলাম। কোন স্মৃতি নিয়ে যাব না। এই পাহাড়,ঝর্ণা,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে আর টানে না। সব কিছু নিছক ছলনা। ইশ্বরের মিথ্যা প্রতিজ্ঞা স্বরূপ৷ দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার ছলনা৷
সৌবীর, যেদিন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেদিন রাতে আমার একদম ঘুম হয়নি। সকালে ভুবন ফোন দিয়ে বলল -দ্রুত নীলকান্তপুর চলে আয়।
আমি নিজেকে কোনভাবে গুছিয়ে বাইকে স্টার্ট দিতে ভুবনের দ্বিতীয় কল
-তুই নীলকান্তপুরের হাসপাতালে চলে আয়।
ওর কন্ঠ তখন ভেজা৷ আমি খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছায়। আমি তখনো কোন অঘটন চিন্তা করিনি।বাহিরে দেখলাম সারা নীলকান্ত পুর এসে হাজির হাসপাতালে। কী হয়েছে, ভাবতে ভাবতে ভেতরে ঢুকতেই দেখি তোমার দিদি মেঝেতে গড়াগড়ি করে কান্না করছে৷ আমি তার কাছে যেতে ই সে আমাকে ছড়িয়ে ধরে আহাজারি করতে লাগল। বিশ্বাস করো,আমি তখনো বুঝতে পারিনি কী ঘটেছে। দিদিকে সামলে হাসপাতালের মর্গের লোক এড়িয়ে ভেতরে যেতে ই দেখি তোমার রক্তাক্ত দেহ। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল৷ গলা শুকিয়ে গিয়েছিল৷ হাত পা কাঁপছিল,পা এলোমেলো ভাবে মাটিতে ফেলে তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সৌবীর,তখন তোমার প্রাণ দেহ ছেড়ে দিয়েছে।তোমার মৃত লাশের সামনে দাঁড়িয়ে দু ফোটা চোখের জল ও আসেনি আমার। শুধু মনে হচ্ছিল, এটা কোন দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই দেখব তুমি আমার পাশে শুয়ে৷ তোমার একটা হাত আমার বুকে, মাথাটা আমার বাহুতে৷
যেদিন তোমার শব পুড়ানো হচ্ছিল সেদিন আমি নাকি হাসপাতালে। আমার কিছু মনে ছিল না। তোমার থেতলে যাওয়া মৃত দেহের উপর কখন আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
বাসায় ফিরি আটদিন পরে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনলাম রাস্তা পাড় হতে গিয়ে গাড়ির তলে চাপা পড়তে যাওয়া নিতাই পালের সাত বছরের মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে বীরের মত নিজের জীবন দিয়ে দিলে।
কেন সৌবীর? কেন তোমাকে বারবার ইশ্বর হতে হবে? আমার কথা না হয় নাই বা ভাবলে, দিদির কথা তো ভাবতে পারতে। তুমি ছাড়া তার ছিল ই বা কে?
বছর দুয়েক আগে তোমার অস্থি বিসর্জনের জন্য বেনারস গিয়েছিলাম। সেদিন সারাদিন অকারণে ই চোখ জলে ভরে উঠছিল৷ সারা এলাকার মানুষ যে ছেলেটার জন্য পাগল ছিল তাকে আমি আপন করে পেয়েছিলাম৷ অথচ নিয়তি তাকে সরিয়ে দিল জীবন থেকে৷ সেদিন তোমার অস্থি বিসর্জনের পর পন্ডিত আমার ধর্ম জানতে চায়ল৷ আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম
-আমি চার্বাক৷
পন্ডিত মশাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ সেই রাতে গঙ্গার তীরে আলোর মেলা বসেছিল। আমার জীবন অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে ইশ্বর নিজের শহর আলোয় আলোকিত করল।
ভোর হতে শুরু করেছে। আমাকে বের হতে হবে৷ ইদানীং খুব মনে পড়ে তোমাকে৷ তোমার চোখ,তোমার হাসি,তোমার এলোমেলো চুল,পাগলামো, চঞ্চলতা, সব কিছু আমাকে কল্পনাগ্রস্ত করে রাখে। জানি আর কোন দিন তোমার সাথে দেখা হবে না। এই জন্মে তো নয় ই৷ আমি অপেক্ষায় আছি, বাকি জন্মগুলোতে যেন তোমাকে ই আমি পায়৷
প্ল্যানে উঠলাম৷ খানিকবাদে ছাড়বে প্ল্যান। সৌবীর,ইশ্বর কি তোমাকে আমার খবর পাঠাই? ইশ্বর কি বলে না তোমায়, মর্ত্যের একটা ভবঘুরে ছেলে তোমায় ভালবেসে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে সম্পুর্ন একা। আমি ভাল নেই প্রিয়৷ নন্দন কাননে তোমার কি মন টিকে আমায় ছাড়া?
ফাগুনের বিলাপ
Reviewed by সমপ্রেমের গল্প
on
February 13, 2021
Rating:
Onk valo laglo
ReplyDeleteamon golpo regular chai..
sunnosthan er last part ta share korben na??