শুণ্যস্থান-১
আরভান শান আরাফ
মাঝরাতে সুমনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ইদানিং প্রায় এমন হচ্ছে৷ অকারণেই ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। সুমন কিছুক্ষণ এ পাশ ওপাশ করলো কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। ব্যর্থ হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সিগারেট ধরালো।তার স্ত্রী মিতু ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। সুমন খেয়াল করলো মিতু ঘুমের মধ্যেই হাসছে। খিলখিল করে হাসি। তবে তার স্থায়িত্ব কম।মিতু কি জেগে আছে? সুমন কি তাকে ডেকে তুলবে?দুজন কিছুক্ষণ গল্প করলে,বারান্দায় হাটাঁহাঁটি করলে হয়তো ঘুম আসবে। না থাক,ও ঘুমাক।সারা দিন প্রচুর খাটাখাটি করতে হচ্ছে৷ কলেজে নাকি কী সব ঝামেলা যাচ্ছে। ছাত্রলীগদের গণ্ডগোলে কলেজ আতঙ্কিত৷ মিতুকে ও বেশ চিন্তিত মনে হল। ওকে সুমন অনেকবার বলেছিল চাকরি বাকরি ছেড়ে দিতে৷ কিন্তু কে শুনে কার কথা?বাচ্চা কাচ্চা নেই, সারাদিন একা একা থাকবে তাই চাকরি করা৷ সুমন ও সারাদিন অফিস, মিটিং নিয়ে থাকে৷ এত বড় বাড়িতে দুজন কাজের লোক,ড্রাইভার,ম্যানেজার কাকা আর তারা স্বামী স্ত্রী। বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে অথচ সন্তান সন্তানি হয়নি। সুমনের বাবা মা দুজন ই গত দু বছর আগে দুই মাসের ব্যবধানে মারা গেল৷ এক বোন ছিল সে ও ততটা আসে না। অভিমান অথবা রাগ৷ সুমন ইদানিং এসব নিয়ে ভাবে না।যা ভেবে কোন অন্ত পাওয়া যাবে না, তা ভেবেই আর কি হবে?চলুক সব কিছু আপনি নিয়মে।
সুমন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়।রাস্তা ফাঁকা৷রাস্তার বামপাশে জামে মসজিদ। ঘন্টা খানেক সময় আছে ফজর হওয়ার। অথচ মুয়াজ্জিন সাহেব চলে এসেছেন। ওনার ও কি রাতে ঘুম হচ্ছে না? বৈদ্যুতিক থাম্ব ঘেঁষে দুটা কুকুর শোয়ে আছে। মাঝে মাঝে এক দুটা রিকশা যাচ্ছে। অকারণেই তারা বেল বাজাচ্ছে। সুমনের মনে হল সে খুব একা। অথচ তেমনটা মনে হওয়ার কোন কারন ই নেই।
রান্নাঘর থেকে চা গরম করে নিয়ে বসতে না বসতে ফজরের আজান দিয়ে দিল। সুমন আশ্বস্ত হল। এখন ভোরের আলো ফোটতে শুরু করবে৷রাত শেষ হবে৷ একা একা এত বড় একটা নির্ঘুম রাত পার করে দেওয়া সহজ ছিল না।
মিতুর ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করলো সুমন বিছানায় নেই। মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখলো সাড়ে পাঁচটা। এত ভোরে জেগে গেল কেন সুমন? ওর কি শরীর খারাপ? মিতু, বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই দেখলো সুমন জগিং করতে বের হচ্ছে৷ সে কিছু বলেনি৷ জগিং থেকে আসলে জিজ্ঞেস করা যাবে।
নাস্তার টেবিলে মিতু আর সুমন খেতে বসেছে। সুমন সকালে লাল আটার রুটি খায়৷ মিতু পাউরুটি আর ডিম ভাজি।মিতু রুটিতে কামড় দিয়ে সুমনের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলো
-রাতে কি তোমার ঘুম হচ্ছে না?
সুমন চুপ করে রইল৷ মিতু আবার প্রশ্ন করলো
-খুব ভোরে জেগে যাচ্ছ ইদানিং। মন ঠিক আছে?
সুমন চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল
-হুম ঠিক আছে। আমি উঠলাম।
মিতু সুমনের খাবার প্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে রইল। আজো সে একটার বেশি রুটি খায়নি। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। সুমন কি কোন কারণে কষ্ট পাচ্ছে?
দুপুরে সুমন বাসায় আসে না। অফিসের ক্যান্টিনে খাবার খায়। সেখানকার খাবার খুব ভাল।ফজলু নামের একজন বাবুর্চি আছে। তার রান্নার হাত অসাধারণ।ফজলুকে আবিষ্কারের পিছনের গল্পটা সুমনের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, নিজেকে এক প্রকার কষ্ট দেওয়ার জন্যই দুপুরের খাবারটা ক্যান্টিনে খায়।
আজ থেকে অনেক দিন আগে, সাত আট বছর আগে। সুমন তখন,২৫ বছরের তরুণ। বাবা মায়ের আদরের রত্ন৷ বোনের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। ইউনিভার্সিটির আদর্শবান তরুণ। চমৎকার সিজিপিএ নিয়ে অনার্স শেষ করে মাস্ট্রার্সের ফাইনালের জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছল তখন এক পড়ন্ত বিকেলে রিকসা করে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় রিকসা উলটে রক্তারক্তি কান্ড। মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। জ্ঞান হারাবার প্রাক্কালে সতেরো আঠারো বয়সের একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখে আশ্বস্ত হয়ে চোখ বুঝলো। জনমানবহীন রাস্তায় মরে পড়ে থাকলে ও কারো খবর পাওয়ার কথা না।
যখন হুশ এল তখন নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলো। আশেপাশে পরিচিত জনের চেহারা দেখে মন হালকা হল।কী ঘটেছিল,কীভাবেই সে বাসায় ফিরলো, ছেলেটাই বা কে? ড্রাইভারের কী হয়েছে এসব জানার চেয়ে তার কাছে মনে হল এখন পড়ায় না বসলে না ই হবে। কাল বাদে পড়শু পরিক্ষা।কবে সবাই বের হবে, কবে সে পড়ার টেবিলে বসবে এসব ভেবে যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল তখন ই তার মনে হল, আজকে মিতুর জন্মদিন। ওর জন্মদিনে না গেলে না ই হবে। হাড় আস্ত রাখবে না।
মিতুর সাথে সুমনের বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। তারপর এতগুলো দিন সেই বন্ধুত্ব টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়৷ কত বার রাগ হল,অভিমান হল,মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। তবো সেই বন্ধুত্ব টিকে রইল। এত গভীর বন্ধুত্ব ই কি তাদের এক সাথে সংসার করার কারন? না। সুমন কোনকালে সেইভাবে ভেবে ই দেখেনি৷ তাদের বিয়ে বাকি সাত আটটা বিয়ের মত ছিল না। সেই সময়টা সুমন ভুলে থাকতে চায়।আর না আসুক সেই সময়টা। ভেসে যাক সব,ডুবে যাক।
সুমন পিছনের দিনগুলো ভাবতে চায় না। জীবনের সব কিছু হারিয়ে, কোনভাবে সে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকাটা সহজ নয় তার জন্য। তবো ও তাকে বেঁচে থাকতে হয়। মিথ্যা সুখের অভিনয়ে এইভাবে তার কেটে যাবে আরো অনেকগুলো দিন। অমৃত্যু তাকে টিকে থাকার জন্য অভিনয় করতে হবে।
আজ সুমন ক্যান্টিনে কিছু খায়নি। বিকেলের দিকে দুজন ক্লাইন্টের সাথে মিটিং শেষে যখন বাসায় ফিরলো তখন মিতু বাসায় ছিল না। সুমন নিজেই কিচেনে চলে গেল। অনেক দিন পর টুকটাক কিছু রান্না করল। একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষ শুধু তার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য দুপুরের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তার বাসায় এসে বসে থাকতো।
ঐ যে, যেদিন সে রিকসা উলটে মাঝরাস্তায় পড়ে ছিল। সেদিন যে ছেলেটা দৌড়ে ছুটে এসছিল। তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেই ছেলেটার সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল আরো সপ্তাহখানেক পরে। সেটা এক বৃষ্টির দিন। সন্ধ্যায় মিতুদের বাসা থেকে ফেরার পথে মুষল ধারে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য রাস্তার পাশে এক চা স্টলে গিয়ে বসলো। তখন ই তার মনে হল পাশের টেবিলে ছোট ছোট দাঁড়ি গোফের যে ছেলেটা অট্টহাস্যে চার পাঁচজনের আড্ডাটাকে মাতিয়ে তুলছে সে কেমন যেন চেনা চেনা।একটু খেয়াল করে যখন মনে হল সেটা আর কেউ নয়, ঐদিনকার উপকারী মানুষটা। তখন টেবিল ছেড়ে আড্ডার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই ঐ ছেলেটা মুখ তুলে তাকিয়ে বলল
-আরে আপনি? সুস্থ্য হয়ে গেছেন?
সুমন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল যে,সে সুস্থ্য হয়ে গেছে। ছেলেটা আবার বলল
-আসুন,বসুন। এই কালু, এখানে একটা চা দে তো।
সুমন বসলো না। না বসেই বলল, ঐদিনকার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বৃষ্টি ছেড়ে দিয়েছিল। সুমন না বসে বলল
-আমি আসি৷ একদিন বাসায় আসবেন।
বলেই চলে গেল।
তারপর আরো অনেকগুলো দিন। এখানে ওখানে দেখা হত৷ কখনো সুমন এড়িয়ে গেছে। কখনো ছেলেটা। কথা বলা, কুশল বিনিময় করা অথবা দু পা হাঁটা যেন আলাদা বিড়ম্বনা।সেই বিড়ম্বনা কাটাতে যখন দুজন ই তৎপর ঠিক সেই সময়টাই ইশ্বর ভিন্ন চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত।
খাবার টেবিলে একদিন সুমনের মা কথা প্রসঙ্গক্রমে বলল
-নিবিড়কে একদিন বাসায় আসতে বলিস। ছেলেটা ঐদিন অনেক করেছে।
সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-নিবিড় কে?
সুমন যতটা অবাক হল তার মা তার চেয়ে দ্বিগুন অবাক হয়ে বলল
-নিবিড় কে চিনিস না? অহনার সাথে পড়ে। ঐদিন যে ছেলেটা তুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।
সুমন মুখে খাবার দিতে দিতে বলল
-ও তাহলে ছেলেটার নাম নিবিড়। তা আমাকে কেন বললে? অহনাকে ই তো বলতে পারো।
-অহনার বলায় আসবে না। অহনা কয়েকবার বলেছে। খুব ই ভাল ছেলে৷ নারে,সুমন?
সুমন কিছু বলেনি। খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল কিছু না বলে।
এতগুলো বছর চলে গেল। কিন্তু সুমনের কাছে মনে হয় সেদিনকার ঘটনা। এই তো সেদিন কলেজের সামনে নিবিড়কে দেখতে পেয়ে ডেকে নিয়ে বাসায় একদিন আসতে বলে সুমন সারা রাত জেগে রইল। বারবার ইচ্ছে করছিল, একদিন দুজন বসে গল্প করলে,পাশাপাশি বসে, হাতে হাত রেখে কথা বললে মন্দ হত না।অথচ সেইদিন গুলো অনেক পুরানো হয়ে গেছে।কোন দিন আর ফিরবে না। মরে পঁচে যাওয়ার মত বিলিন হয়ে গেছে৷
মিতু বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। সুমন তখন ছাদে বসে ছিল। মিতু চুপচাপ এসে পাশে দাঁড়ালো।সুমন ফিরে মিতুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল
-এত দেরি করলে কেন? কোন সমস্যা?
-অহনার বাসায় গিয়েছিলাম।রাস্তায় দেখতে পেয়ে টেনে নিয়ে গেলো।
-কেমন আছে ও?
-ভাল৷ তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
-ও
সুমন আর অধিক কথা বলল না। নিজের রুমে চলে গেল।
নিবিড় আর অহনা ছিল হরিহর প্রাণ৷ অথচ, ঐদিনকার আগে সেটা ওর জানা ছিল না। সারাদিন, বই নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছেলেটা কিছু ই জানতো না। সমাজ,পরিবার,বন্ধুত্ব,আড্ডা আর ভালবাসা তো শিখিয়েছিল নিবিড়।
একদিন সারাদিন রুমে বসে থেকে থেকে যখন বিরক্তি চরম সীমানায় তখন অহনাকে ব্যস্ত হয়ে নিচ তলায় যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল
-কী হয়েছে রে?
অহনা মুখ বাঁকা করে বলল
-কিছু না।
সুমন আগ্রহবশত ঘর ছেড়ে বের হতেই দেখে নিচে নিবিড় আর দু একজন ছেলে মেয়ে আড্ডায় মজে আছে। সুমনের দৃষ্টি আটকে গেল নিবিড়ের দিকে৷ কি মুগ্ধকর ছেলেটা,তার হাসি,শরীরের ভাষা,চোখ আর মাথার কুকড়ানো চুলগুলো। সুমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিবিড়ের চোখ উপরের দিকে যেতেই সুমন চোখ ফিরিয়ে নিল।সুমন নিজের রুমে গিয়ে বসতেই, নিবিড় এসে দরজার পাশে দাঁড়াল।
-আসব?
সুমন লজ্জায় লাল হয়ে বলল
-হুম আসো। বলতে হবে নাকি?
নিবিড় এসে একদম সুমনের শরীর ঘেঁষে বসলো। সুমনের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। মনে হল, ওকে একটু ছোঁয়ে দেখতে, ইচ্ছে করছিল কোন এক আদমতায় ভেসে যেতে। ভেতরে ভেতরে সে কি ভাঙ্গন। বদ্ধ ঘরে মিনিট দশেক দুজনেই বসে ছিল চুপচাপ। কথা বলল নিবিড়
-একদম বের হন না, বাসা থেকে?
-হয় তো। তবে কম।
-যাবেন একদিন আমার সাথে?
সুমন নিবিড়ের দিকে তাকালো। তার চোখের দিকে চোখ রেখে বলল
-হুম।যাব। কোথায় নিয়ে যাবে?
-কাল সকালে আসবো।
বলে উঠে গেল নিবিড়। সুমন কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
সারা রাত তার কেটেছিল ঘুমহীনভাবে। ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিল। আর তখন ই ঘটল জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা৷ নিবিড়কে স্বপ্নে দেখে তার স্বপ্ন দোষ হল। লজ্জায় ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতে দেখলো নিবিড় বসে আছে। সে আজ পাঞ্জাবি পড়েছে। পাঞ্জাবীতে তাকে অন্যদিনের চেয়ে সুন্দর লাগছে। সুমন কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
সেদিনকার ঘটনাগুলো তার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে আছে যে চাইলে ই ভুলা যাবে না। সুমন শতবার চেয়েছে ভুলে যেতে কিন্তু হৃদয় যেখানে বন্দি সেখানকার স্মৃতি ভুলাটা কি এতই সোজা?
ঐদিন নিবিড় সুমনকে নিয়ে গিয়েছিল পুরানো এক শশ্মান ঘাটে। বড় বড় বট গাছ, পাশে সরু নদী, যার পানি ছিল কাক চক্ষুর মত স্বচ্ছ।স্নিগ্ধ বাতাসে বটতলায় বসে সেদিন প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল সুমনের। সেদিন প্রথমবার নিবিড়ের কপালে সুমন চুমু খেয়ে বলেছিল তার মনের কথা৷ বলেছিল, তার হৃদয়ের আবেদন। সেই দিন শশ্মানে ঘাটে বসে এক যুবক আরেক যুবকের প্রেমে পড়ে ইশ্বরকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিল চিরকাল এক সাথে থাকার।
তারপরে বহুদিন বহুবার তাদের দেখা হত৷ একটা সময় দুজন দুজনের জন্য মত্ত থাকতো। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে আশ্রয় হল পরস্পরের।
এতটা সময় পার হয়ে গেছে।সুমন এখন সাংসারিক।মিতু নামের একজনের স্বামী। যখন রাত হয় দুজন একি বিছানায় পাশাপাশি শোয়ে থাকে। আবেগে মিতু কখনো সুমনের শরীরে হাত রাখে৷ তার বুক পশমে আলতো করে বিলি কাটে। সুমন শুধু মিতুকে কষ্ট দিবে না বলে তার কপালে চুমু খায়। তার শরীর স্পর্শ করে। তাকে বুঝতে দেয় না যে, সে যখন তাকে স্পর্শ করে তখন ভেতর কাঁপিয়ে কান্না আসে। তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিবিড়ের স্পর্শ মিশে আছে। তার মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন প্রথম নিবিড় তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল,চিরকালের তৃপ্তিদায়ক সেই কথা 'ভালবাসি'।তার মনে পড়ে সেই রাতের কথা যেদিন নিবিড় সুমনের বুকে মাথা রেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলেছিল 'ছেড়ে যাবে না তো''
এক সন্ধ্যায় বাসায় সেদিন কেউ ছিল না। নিবিড় এসে হাজির আনন্দচিত্তে৷ সুমন নিবিড়কে দেখতে পেয়ে ভেতরকার উচ্ছ্বাস দমিয়ে পলকহীন চোখে জিজ্ঞেস করল
-এই সন্ধ্যায়?
নিবিড় সোফায় গাঁ এলিয়ে বসে বলল
-তোমার হাতের রান্না খেতে এসেছি। অহনা বলল তার ভাই নাকি ভাল রাধে।
সুমন মুচকি হেসে রান্না ঘরে ঢুকে গেল। সেদিনকার পরে, নিবিড় শতবার শতবাহানায় সুমনের হাতের রান্নার আবদার করে বসত।
সম্পর্কটা যখন নিজেদের মত করে বড় হচ্ছিল তখন ই ঘটে গেল অদ্ভুত কিছু ঘটনা৷ চিরকাল বন্ধু হয়ে থাকা মিতু বাসায় জানিয়ে দিল, বিয়ে করলে সে সুমনকে ই করবে।
সুমন খবরটা শোনার পর মিতুর সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেয়। এতে কিন্তুর মিতুর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। সে তারমত ই।সারাদিন চিকন ফ্রেমের চশমা পড়ে সে বই কুলে নিয়ে বসে থাকে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়নি তবে একবেলা এক মুষ্টির বেশি তাকে কেউ খেতে ও দেখেনি। বাবা, মা বড় ভাই সবাই তার পক্ষে৷ কিন্তু যে মানুষটার জন্য তার এত কষ্ট সে ছিল বিপক্ষে।
অহনা তখন উভয় সংকটে। একদিন নিবিড়কে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল, সুমনের সাথে এত আন্তরিকতার কারন কী? নিবিড় কিছু বলেনি। কিন্তু অহনা নিবিড়ের চোখ মুখ দেখে যে বিষয়টা বুঝেছিল সেটা ভেবে তার রাতে ঘুম হচ্ছিল না।
অহনা কি বুঝতে পেরেছিল যে,তার ভাই প্রচন্ডরকম ভালবাসে নিবিড়কে। নাকি সে ও অন্যদের মতই ছিল।
সুমনের প্রায় মনে পড়ে।। রাতের খাবার টেবিলে মিতু সুমনের প্ল্যাটে তরকারি দিতে দিতে বলল,
-অহনা বলছিল আমাদের দুজনকে একবার তার বাসায় যেতে। যাবে একদিন?
-না। তুমি যাও৷ আমার সময় হবে না।
সুমনের গম্ভীর উত্তর শুনে মিতু চুপ হয়ে গেল৷ পুনরায় কোন প্রকার প্রশ্ন না করে নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে চলে গেল।
ছাদে গিয়ে সে আর তার চোখের পানি আটকাতে পারেনি। ভেতর ফেটে কান্না আসছিল। নিজেকে কোনভাবে শান্ত করে চোখের পানি মুছে নিচের দিকে নেমে গেল। সুমন কিন্তু ঠিক ই বুঝেছে যে মিতু তার গৃহে ভাল নেই। আসলে কেউ ই ভাল নেই। সবাই একি যন্ত্রনা নিয়ে চলছে।
এই যন্ত্রনাটা শুরু হয়েছিল সেদিন,যেদিন মিতু হাতের রগ কেটে ফেলেছিল।নিবিড় আর অহনা তখন উভয় সংকটে। অহনা জানে তার ভাই অন্য আটদশটা ছেলের মত নয়। সে জানে তার ভাই নিবিড়কে ভালবাসে৷ সারা জীবন একি সাথে থাকার জন্য তারা ওয়াদাবদ্ধ৷ কিন্তু, তবো অহনার ভয় হত। সমাজ আর পরিবারের ভয়। তার বন্ধু নিবিড় আর সুমন কি সমাজ আর পরিবার এড়িয়ে বাঁচতে পারবে?সেদিন অহনা নিবিড়কে জিজ্ঞেস করেছিল, তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি। নিবিড় মুচকি হেসে বলেছিল
-সারা জীবন তুদের সাথে থাকা।
অহনা চোখ দুটি উপরে তুলে বলল
-আমাদের সাথে মানে?
-তুই, সুমন।
অহনা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। চলুক। তারা ভাল থাকলেই সে খুশি। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই বাড়ি থেকে সুমনকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল৷ একদিকে মিতুর সুইসাইড করার চেষ্টা, অন্যদিকে সুমনের বাবা মায়ের প্রেসার সব মিলিয়ে সুমনের জীবন তখন ভয়াবহ নরকে পরিপূর্ণ হয়েছে।
ঘটনা সেখানে ও থেমে থাকেনি। সুমনের আম্মু নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একজন সন্তান সব যন্ত্রনা আর পরিতাপ সহ্য করে নিতে পারে। কিন্তু মায়ের কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে সহজ না। সুমন ও পারেনি৷ সে রাজি হয়ে যায় মিতুকে বিয়ে করার জন্য। শুরুতে অহনা এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তার ভাইয়ের নরক ভোগ।
নিবিড় তখনো কিছু জানতো না। সে গ্রামে গিয়েছিল তার নানা ভাইয়ের অসুস্থ্যের কথা শুনে। অহনা,সুমন কেউ তাকে কিছুই বলেনি। নিবিড় সুমনের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়ে গ্রামে যাওয়ার চতুর্থ দিনের মাথায় অহনাকে কল করল।
সেইদিন সুমনের গাঁয়ে হলুদ। অহনা নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বাড়ি ভরতি মানুষ। নিবিড়ের ফোন পেয়ে তার বুকটা কেঁপে উঠল। সে কী বলবে নিবিড়কে? সব কিছু শোনার পরে নিবিড় বেঁচে থাকতে পারবে তো? যে মানুষটাকে এতটা ভালবাসে, যে মানুষটাকে নিয়ে এত স্বপ্ন সাজালো, যে মানুষটা তাকে চিরকাল একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে যখন তাকে ছেড়ে আইনত,সামাজিকভাবে আরেকজনের হয়ে যাবে সেটা কি মেনে নিতে পারবে নিবিড়। অহনার সাহস হয়নি ফোনটা ধরার।
ঐদিকে সুমনের বিয়ের দিন নিবিড় উন্মাদের মত ছুটে এল। বাড়িতে আলোক সজ্জা,গেইট আর লোকারণ্য দেখে তার বুকটা মুচড় দিয়ে উঠল। তিন চার মিনিট গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল বরফের মত।এক সময় চোখের সামনে যখন গাড়িটা এসে থামল তখন তার দৃষ্টি গেল সেই গাড়িটার দিকে। তাকাতেই তার মনে হল পৃথিবীটা ধবংস হয়ে যাচ্ছে।মাথাটা ভনভন করতে লাগলো, গলা শুকিয়ে গেল, পা কাঁপতে লাগল। খানিকের জন্য তার মনে হল সব স্বপ্ন৷ মিথ্যা। গাড়িতে বউ নিয়ে যে বসে আছে সেটা সুমন না। অন্য কেউ৷
সুমন গাড়িতে মাথা নিচু করে বসে ছিল।সে তাকিয়ে ও দেখেনি যে, একটা ছেলে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে। যার চোখের পানি গাল বেয়ে ঝড়ছে।
তারপর সুমন অনেকবার চেয়েছিল নিবিড়ের সাথে যোগাযোগ করতে৷ কিন্তু সে খোঁজে পায়নি৷ অহনা,সুমন অথবা নিবিড়ের বন্ধু বান্ধব কেউ ই তার খবর রাখেনি। একটা মানুষ বিলিন হয়ে গেল। কেউ তার খবর রাখেনি। এমন কি নিবিড়ের নানা বাড়িতে ও তার কোন খবর ছিল না৷ অহনা এর পরে আর কোন দিন সুমনের সাথে কথা বলেনি। প্রচন্ড অভিমানে সে বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে উঠে গেল। আর ফিরেনি।
এতগুলা বছর হয়ে গেল অথচ সুমন আর কোন দিন তার খবর পাইনি। হারিয়ে গেছে চিরতরে।
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর চলে গেল। সুমন অনেকটা মরে যাওয়ার মত বেঁচে আছে। মিতুর সাথে মিছে মিছে সংসার। লোক দেখানো মিছে সম্পর্ক। পাঁচ বছর আগে যে ছেলেটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তার জন্য তার ভেতরটা সারাক্ষণ কাঁদে৷ইশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা কোন একদিন পথ চলতে চলতে যেন তাদের দেখা হয় যায়।
আরভান শান আরাফ
মাঝরাতে সুমনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ইদানিং প্রায় এমন হচ্ছে৷ অকারণেই ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। সুমন কিছুক্ষণ এ পাশ ওপাশ করলো কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। ব্যর্থ হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সিগারেট ধরালো।তার স্ত্রী মিতু ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। সুমন খেয়াল করলো মিতু ঘুমের মধ্যেই হাসছে। খিলখিল করে হাসি। তবে তার স্থায়িত্ব কম।মিতু কি জেগে আছে? সুমন কি তাকে ডেকে তুলবে?দুজন কিছুক্ষণ গল্প করলে,বারান্দায় হাটাঁহাঁটি করলে হয়তো ঘুম আসবে। না থাক,ও ঘুমাক।সারা দিন প্রচুর খাটাখাটি করতে হচ্ছে৷ কলেজে নাকি কী সব ঝামেলা যাচ্ছে। ছাত্রলীগদের গণ্ডগোলে কলেজ আতঙ্কিত৷ মিতুকে ও বেশ চিন্তিত মনে হল। ওকে সুমন অনেকবার বলেছিল চাকরি বাকরি ছেড়ে দিতে৷ কিন্তু কে শুনে কার কথা?বাচ্চা কাচ্চা নেই, সারাদিন একা একা থাকবে তাই চাকরি করা৷ সুমন ও সারাদিন অফিস, মিটিং নিয়ে থাকে৷ এত বড় বাড়িতে দুজন কাজের লোক,ড্রাইভার,ম্যানেজার কাকা আর তারা স্বামী স্ত্রী। বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে অথচ সন্তান সন্তানি হয়নি। সুমনের বাবা মা দুজন ই গত দু বছর আগে দুই মাসের ব্যবধানে মারা গেল৷ এক বোন ছিল সে ও ততটা আসে না। অভিমান অথবা রাগ৷ সুমন ইদানিং এসব নিয়ে ভাবে না।যা ভেবে কোন অন্ত পাওয়া যাবে না, তা ভেবেই আর কি হবে?চলুক সব কিছু আপনি নিয়মে।
সুমন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়।রাস্তা ফাঁকা৷রাস্তার বামপাশে জামে মসজিদ। ঘন্টা খানেক সময় আছে ফজর হওয়ার। অথচ মুয়াজ্জিন সাহেব চলে এসেছেন। ওনার ও কি রাতে ঘুম হচ্ছে না? বৈদ্যুতিক থাম্ব ঘেঁষে দুটা কুকুর শোয়ে আছে। মাঝে মাঝে এক দুটা রিকশা যাচ্ছে। অকারণেই তারা বেল বাজাচ্ছে। সুমনের মনে হল সে খুব একা। অথচ তেমনটা মনে হওয়ার কোন কারন ই নেই।
রান্নাঘর থেকে চা গরম করে নিয়ে বসতে না বসতে ফজরের আজান দিয়ে দিল। সুমন আশ্বস্ত হল। এখন ভোরের আলো ফোটতে শুরু করবে৷রাত শেষ হবে৷ একা একা এত বড় একটা নির্ঘুম রাত পার করে দেওয়া সহজ ছিল না।
মিতুর ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করলো সুমন বিছানায় নেই। মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখলো সাড়ে পাঁচটা। এত ভোরে জেগে গেল কেন সুমন? ওর কি শরীর খারাপ? মিতু, বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই দেখলো সুমন জগিং করতে বের হচ্ছে৷ সে কিছু বলেনি৷ জগিং থেকে আসলে জিজ্ঞেস করা যাবে।
নাস্তার টেবিলে মিতু আর সুমন খেতে বসেছে। সুমন সকালে লাল আটার রুটি খায়৷ মিতু পাউরুটি আর ডিম ভাজি।মিতু রুটিতে কামড় দিয়ে সুমনের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলো
-রাতে কি তোমার ঘুম হচ্ছে না?
সুমন চুপ করে রইল৷ মিতু আবার প্রশ্ন করলো
-খুব ভোরে জেগে যাচ্ছ ইদানিং। মন ঠিক আছে?
সুমন চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল
-হুম ঠিক আছে। আমি উঠলাম।
মিতু সুমনের খাবার প্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে রইল। আজো সে একটার বেশি রুটি খায়নি। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। সুমন কি কোন কারণে কষ্ট পাচ্ছে?
দুপুরে সুমন বাসায় আসে না। অফিসের ক্যান্টিনে খাবার খায়। সেখানকার খাবার খুব ভাল।ফজলু নামের একজন বাবুর্চি আছে। তার রান্নার হাত অসাধারণ।ফজলুকে আবিষ্কারের পিছনের গল্পটা সুমনের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, নিজেকে এক প্রকার কষ্ট দেওয়ার জন্যই দুপুরের খাবারটা ক্যান্টিনে খায়।
আজ থেকে অনেক দিন আগে, সাত আট বছর আগে। সুমন তখন,২৫ বছরের তরুণ। বাবা মায়ের আদরের রত্ন৷ বোনের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। ইউনিভার্সিটির আদর্শবান তরুণ। চমৎকার সিজিপিএ নিয়ে অনার্স শেষ করে মাস্ট্রার্সের ফাইনালের জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছল তখন এক পড়ন্ত বিকেলে রিকসা করে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় রিকসা উলটে রক্তারক্তি কান্ড। মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। জ্ঞান হারাবার প্রাক্কালে সতেরো আঠারো বয়সের একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখে আশ্বস্ত হয়ে চোখ বুঝলো। জনমানবহীন রাস্তায় মরে পড়ে থাকলে ও কারো খবর পাওয়ার কথা না।
যখন হুশ এল তখন নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলো। আশেপাশে পরিচিত জনের চেহারা দেখে মন হালকা হল।কী ঘটেছিল,কীভাবেই সে বাসায় ফিরলো, ছেলেটাই বা কে? ড্রাইভারের কী হয়েছে এসব জানার চেয়ে তার কাছে মনে হল এখন পড়ায় না বসলে না ই হবে। কাল বাদে পড়শু পরিক্ষা।কবে সবাই বের হবে, কবে সে পড়ার টেবিলে বসবে এসব ভেবে যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল তখন ই তার মনে হল, আজকে মিতুর জন্মদিন। ওর জন্মদিনে না গেলে না ই হবে। হাড় আস্ত রাখবে না।
মিতুর সাথে সুমনের বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। তারপর এতগুলো দিন সেই বন্ধুত্ব টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়৷ কত বার রাগ হল,অভিমান হল,মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। তবো সেই বন্ধুত্ব টিকে রইল। এত গভীর বন্ধুত্ব ই কি তাদের এক সাথে সংসার করার কারন? না। সুমন কোনকালে সেইভাবে ভেবে ই দেখেনি৷ তাদের বিয়ে বাকি সাত আটটা বিয়ের মত ছিল না। সেই সময়টা সুমন ভুলে থাকতে চায়।আর না আসুক সেই সময়টা। ভেসে যাক সব,ডুবে যাক।
সুমন পিছনের দিনগুলো ভাবতে চায় না। জীবনের সব কিছু হারিয়ে, কোনভাবে সে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকাটা সহজ নয় তার জন্য। তবো ও তাকে বেঁচে থাকতে হয়। মিথ্যা সুখের অভিনয়ে এইভাবে তার কেটে যাবে আরো অনেকগুলো দিন। অমৃত্যু তাকে টিকে থাকার জন্য অভিনয় করতে হবে।
আজ সুমন ক্যান্টিনে কিছু খায়নি। বিকেলের দিকে দুজন ক্লাইন্টের সাথে মিটিং শেষে যখন বাসায় ফিরলো তখন মিতু বাসায় ছিল না। সুমন নিজেই কিচেনে চলে গেল। অনেক দিন পর টুকটাক কিছু রান্না করল। একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষ শুধু তার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য দুপুরের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তার বাসায় এসে বসে থাকতো।
ঐ যে, যেদিন সে রিকসা উলটে মাঝরাস্তায় পড়ে ছিল। সেদিন যে ছেলেটা দৌড়ে ছুটে এসছিল। তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেই ছেলেটার সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল আরো সপ্তাহখানেক পরে। সেটা এক বৃষ্টির দিন। সন্ধ্যায় মিতুদের বাসা থেকে ফেরার পথে মুষল ধারে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য রাস্তার পাশে এক চা স্টলে গিয়ে বসলো। তখন ই তার মনে হল পাশের টেবিলে ছোট ছোট দাঁড়ি গোফের যে ছেলেটা অট্টহাস্যে চার পাঁচজনের আড্ডাটাকে মাতিয়ে তুলছে সে কেমন যেন চেনা চেনা।একটু খেয়াল করে যখন মনে হল সেটা আর কেউ নয়, ঐদিনকার উপকারী মানুষটা। তখন টেবিল ছেড়ে আড্ডার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই ঐ ছেলেটা মুখ তুলে তাকিয়ে বলল
-আরে আপনি? সুস্থ্য হয়ে গেছেন?
সুমন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল যে,সে সুস্থ্য হয়ে গেছে। ছেলেটা আবার বলল
-আসুন,বসুন। এই কালু, এখানে একটা চা দে তো।
সুমন বসলো না। না বসেই বলল, ঐদিনকার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বৃষ্টি ছেড়ে দিয়েছিল। সুমন না বসে বলল
-আমি আসি৷ একদিন বাসায় আসবেন।
বলেই চলে গেল।
তারপর আরো অনেকগুলো দিন। এখানে ওখানে দেখা হত৷ কখনো সুমন এড়িয়ে গেছে। কখনো ছেলেটা। কথা বলা, কুশল বিনিময় করা অথবা দু পা হাঁটা যেন আলাদা বিড়ম্বনা।সেই বিড়ম্বনা কাটাতে যখন দুজন ই তৎপর ঠিক সেই সময়টাই ইশ্বর ভিন্ন চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত।
খাবার টেবিলে একদিন সুমনের মা কথা প্রসঙ্গক্রমে বলল
-নিবিড়কে একদিন বাসায় আসতে বলিস। ছেলেটা ঐদিন অনেক করেছে।
সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-নিবিড় কে?
সুমন যতটা অবাক হল তার মা তার চেয়ে দ্বিগুন অবাক হয়ে বলল
-নিবিড় কে চিনিস না? অহনার সাথে পড়ে। ঐদিন যে ছেলেটা তুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।
সুমন মুখে খাবার দিতে দিতে বলল
-ও তাহলে ছেলেটার নাম নিবিড়। তা আমাকে কেন বললে? অহনাকে ই তো বলতে পারো।
-অহনার বলায় আসবে না। অহনা কয়েকবার বলেছে। খুব ই ভাল ছেলে৷ নারে,সুমন?
সুমন কিছু বলেনি। খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল কিছু না বলে।
এতগুলো বছর চলে গেল। কিন্তু সুমনের কাছে মনে হয় সেদিনকার ঘটনা। এই তো সেদিন কলেজের সামনে নিবিড়কে দেখতে পেয়ে ডেকে নিয়ে বাসায় একদিন আসতে বলে সুমন সারা রাত জেগে রইল। বারবার ইচ্ছে করছিল, একদিন দুজন বসে গল্প করলে,পাশাপাশি বসে, হাতে হাত রেখে কথা বললে মন্দ হত না।অথচ সেইদিন গুলো অনেক পুরানো হয়ে গেছে।কোন দিন আর ফিরবে না। মরে পঁচে যাওয়ার মত বিলিন হয়ে গেছে৷
মিতু বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। সুমন তখন ছাদে বসে ছিল। মিতু চুপচাপ এসে পাশে দাঁড়ালো।সুমন ফিরে মিতুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল
-এত দেরি করলে কেন? কোন সমস্যা?
-অহনার বাসায় গিয়েছিলাম।রাস্তায় দেখতে পেয়ে টেনে নিয়ে গেলো।
-কেমন আছে ও?
-ভাল৷ তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
-ও
সুমন আর অধিক কথা বলল না। নিজের রুমে চলে গেল।
নিবিড় আর অহনা ছিল হরিহর প্রাণ৷ অথচ, ঐদিনকার আগে সেটা ওর জানা ছিল না। সারাদিন, বই নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছেলেটা কিছু ই জানতো না। সমাজ,পরিবার,বন্ধুত্ব,আড্ডা আর ভালবাসা তো শিখিয়েছিল নিবিড়।
একদিন সারাদিন রুমে বসে থেকে থেকে যখন বিরক্তি চরম সীমানায় তখন অহনাকে ব্যস্ত হয়ে নিচ তলায় যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল
-কী হয়েছে রে?
অহনা মুখ বাঁকা করে বলল
-কিছু না।
সুমন আগ্রহবশত ঘর ছেড়ে বের হতেই দেখে নিচে নিবিড় আর দু একজন ছেলে মেয়ে আড্ডায় মজে আছে। সুমনের দৃষ্টি আটকে গেল নিবিড়ের দিকে৷ কি মুগ্ধকর ছেলেটা,তার হাসি,শরীরের ভাষা,চোখ আর মাথার কুকড়ানো চুলগুলো। সুমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিবিড়ের চোখ উপরের দিকে যেতেই সুমন চোখ ফিরিয়ে নিল।সুমন নিজের রুমে গিয়ে বসতেই, নিবিড় এসে দরজার পাশে দাঁড়াল।
-আসব?
সুমন লজ্জায় লাল হয়ে বলল
-হুম আসো। বলতে হবে নাকি?
নিবিড় এসে একদম সুমনের শরীর ঘেঁষে বসলো। সুমনের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। মনে হল, ওকে একটু ছোঁয়ে দেখতে, ইচ্ছে করছিল কোন এক আদমতায় ভেসে যেতে। ভেতরে ভেতরে সে কি ভাঙ্গন। বদ্ধ ঘরে মিনিট দশেক দুজনেই বসে ছিল চুপচাপ। কথা বলল নিবিড়
-একদম বের হন না, বাসা থেকে?
-হয় তো। তবে কম।
-যাবেন একদিন আমার সাথে?
সুমন নিবিড়ের দিকে তাকালো। তার চোখের দিকে চোখ রেখে বলল
-হুম।যাব। কোথায় নিয়ে যাবে?
-কাল সকালে আসবো।
বলে উঠে গেল নিবিড়। সুমন কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
সারা রাত তার কেটেছিল ঘুমহীনভাবে। ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিল। আর তখন ই ঘটল জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা৷ নিবিড়কে স্বপ্নে দেখে তার স্বপ্ন দোষ হল। লজ্জায় ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতে দেখলো নিবিড় বসে আছে। সে আজ পাঞ্জাবি পড়েছে। পাঞ্জাবীতে তাকে অন্যদিনের চেয়ে সুন্দর লাগছে। সুমন কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
সেদিনকার ঘটনাগুলো তার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে আছে যে চাইলে ই ভুলা যাবে না। সুমন শতবার চেয়েছে ভুলে যেতে কিন্তু হৃদয় যেখানে বন্দি সেখানকার স্মৃতি ভুলাটা কি এতই সোজা?
ঐদিন নিবিড় সুমনকে নিয়ে গিয়েছিল পুরানো এক শশ্মান ঘাটে। বড় বড় বট গাছ, পাশে সরু নদী, যার পানি ছিল কাক চক্ষুর মত স্বচ্ছ।স্নিগ্ধ বাতাসে বটতলায় বসে সেদিন প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল সুমনের। সেদিন প্রথমবার নিবিড়ের কপালে সুমন চুমু খেয়ে বলেছিল তার মনের কথা৷ বলেছিল, তার হৃদয়ের আবেদন। সেই দিন শশ্মানে ঘাটে বসে এক যুবক আরেক যুবকের প্রেমে পড়ে ইশ্বরকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিল চিরকাল এক সাথে থাকার।
তারপরে বহুদিন বহুবার তাদের দেখা হত৷ একটা সময় দুজন দুজনের জন্য মত্ত থাকতো। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে আশ্রয় হল পরস্পরের।
এতটা সময় পার হয়ে গেছে।সুমন এখন সাংসারিক।মিতু নামের একজনের স্বামী। যখন রাত হয় দুজন একি বিছানায় পাশাপাশি শোয়ে থাকে। আবেগে মিতু কখনো সুমনের শরীরে হাত রাখে৷ তার বুক পশমে আলতো করে বিলি কাটে। সুমন শুধু মিতুকে কষ্ট দিবে না বলে তার কপালে চুমু খায়। তার শরীর স্পর্শ করে। তাকে বুঝতে দেয় না যে, সে যখন তাকে স্পর্শ করে তখন ভেতর কাঁপিয়ে কান্না আসে। তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিবিড়ের স্পর্শ মিশে আছে। তার মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন প্রথম নিবিড় তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল,চিরকালের তৃপ্তিদায়ক সেই কথা 'ভালবাসি'।তার মনে পড়ে সেই রাতের কথা যেদিন নিবিড় সুমনের বুকে মাথা রেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলেছিল 'ছেড়ে যাবে না তো''
এক সন্ধ্যায় বাসায় সেদিন কেউ ছিল না। নিবিড় এসে হাজির আনন্দচিত্তে৷ সুমন নিবিড়কে দেখতে পেয়ে ভেতরকার উচ্ছ্বাস দমিয়ে পলকহীন চোখে জিজ্ঞেস করল
-এই সন্ধ্যায়?
নিবিড় সোফায় গাঁ এলিয়ে বসে বলল
-তোমার হাতের রান্না খেতে এসেছি। অহনা বলল তার ভাই নাকি ভাল রাধে।
সুমন মুচকি হেসে রান্না ঘরে ঢুকে গেল। সেদিনকার পরে, নিবিড় শতবার শতবাহানায় সুমনের হাতের রান্নার আবদার করে বসত।
সম্পর্কটা যখন নিজেদের মত করে বড় হচ্ছিল তখন ই ঘটে গেল অদ্ভুত কিছু ঘটনা৷ চিরকাল বন্ধু হয়ে থাকা মিতু বাসায় জানিয়ে দিল, বিয়ে করলে সে সুমনকে ই করবে।
সুমন খবরটা শোনার পর মিতুর সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেয়। এতে কিন্তুর মিতুর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। সে তারমত ই।সারাদিন চিকন ফ্রেমের চশমা পড়ে সে বই কুলে নিয়ে বসে থাকে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়নি তবে একবেলা এক মুষ্টির বেশি তাকে কেউ খেতে ও দেখেনি। বাবা, মা বড় ভাই সবাই তার পক্ষে৷ কিন্তু যে মানুষটার জন্য তার এত কষ্ট সে ছিল বিপক্ষে।
অহনা তখন উভয় সংকটে। একদিন নিবিড়কে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল, সুমনের সাথে এত আন্তরিকতার কারন কী? নিবিড় কিছু বলেনি। কিন্তু অহনা নিবিড়ের চোখ মুখ দেখে যে বিষয়টা বুঝেছিল সেটা ভেবে তার রাতে ঘুম হচ্ছিল না।
অহনা কি বুঝতে পেরেছিল যে,তার ভাই প্রচন্ডরকম ভালবাসে নিবিড়কে। নাকি সে ও অন্যদের মতই ছিল।
সুমনের প্রায় মনে পড়ে।। রাতের খাবার টেবিলে মিতু সুমনের প্ল্যাটে তরকারি দিতে দিতে বলল,
-অহনা বলছিল আমাদের দুজনকে একবার তার বাসায় যেতে। যাবে একদিন?
-না। তুমি যাও৷ আমার সময় হবে না।
সুমনের গম্ভীর উত্তর শুনে মিতু চুপ হয়ে গেল৷ পুনরায় কোন প্রকার প্রশ্ন না করে নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে চলে গেল।
ছাদে গিয়ে সে আর তার চোখের পানি আটকাতে পারেনি। ভেতর ফেটে কান্না আসছিল। নিজেকে কোনভাবে শান্ত করে চোখের পানি মুছে নিচের দিকে নেমে গেল। সুমন কিন্তু ঠিক ই বুঝেছে যে মিতু তার গৃহে ভাল নেই। আসলে কেউ ই ভাল নেই। সবাই একি যন্ত্রনা নিয়ে চলছে।
এই যন্ত্রনাটা শুরু হয়েছিল সেদিন,যেদিন মিতু হাতের রগ কেটে ফেলেছিল।নিবিড় আর অহনা তখন উভয় সংকটে। অহনা জানে তার ভাই অন্য আটদশটা ছেলের মত নয়। সে জানে তার ভাই নিবিড়কে ভালবাসে৷ সারা জীবন একি সাথে থাকার জন্য তারা ওয়াদাবদ্ধ৷ কিন্তু, তবো অহনার ভয় হত। সমাজ আর পরিবারের ভয়। তার বন্ধু নিবিড় আর সুমন কি সমাজ আর পরিবার এড়িয়ে বাঁচতে পারবে?সেদিন অহনা নিবিড়কে জিজ্ঞেস করেছিল, তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি। নিবিড় মুচকি হেসে বলেছিল
-সারা জীবন তুদের সাথে থাকা।
অহনা চোখ দুটি উপরে তুলে বলল
-আমাদের সাথে মানে?
-তুই, সুমন।
অহনা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। চলুক। তারা ভাল থাকলেই সে খুশি। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই বাড়ি থেকে সুমনকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল৷ একদিকে মিতুর সুইসাইড করার চেষ্টা, অন্যদিকে সুমনের বাবা মায়ের প্রেসার সব মিলিয়ে সুমনের জীবন তখন ভয়াবহ নরকে পরিপূর্ণ হয়েছে।
ঘটনা সেখানে ও থেমে থাকেনি। সুমনের আম্মু নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একজন সন্তান সব যন্ত্রনা আর পরিতাপ সহ্য করে নিতে পারে। কিন্তু মায়ের কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে সহজ না। সুমন ও পারেনি৷ সে রাজি হয়ে যায় মিতুকে বিয়ে করার জন্য। শুরুতে অহনা এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তার ভাইয়ের নরক ভোগ।
নিবিড় তখনো কিছু জানতো না। সে গ্রামে গিয়েছিল তার নানা ভাইয়ের অসুস্থ্যের কথা শুনে। অহনা,সুমন কেউ তাকে কিছুই বলেনি। নিবিড় সুমনের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়ে গ্রামে যাওয়ার চতুর্থ দিনের মাথায় অহনাকে কল করল।
সেইদিন সুমনের গাঁয়ে হলুদ। অহনা নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বাড়ি ভরতি মানুষ। নিবিড়ের ফোন পেয়ে তার বুকটা কেঁপে উঠল। সে কী বলবে নিবিড়কে? সব কিছু শোনার পরে নিবিড় বেঁচে থাকতে পারবে তো? যে মানুষটাকে এতটা ভালবাসে, যে মানুষটাকে নিয়ে এত স্বপ্ন সাজালো, যে মানুষটা তাকে চিরকাল একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে যখন তাকে ছেড়ে আইনত,সামাজিকভাবে আরেকজনের হয়ে যাবে সেটা কি মেনে নিতে পারবে নিবিড়। অহনার সাহস হয়নি ফোনটা ধরার।
ঐদিকে সুমনের বিয়ের দিন নিবিড় উন্মাদের মত ছুটে এল। বাড়িতে আলোক সজ্জা,গেইট আর লোকারণ্য দেখে তার বুকটা মুচড় দিয়ে উঠল। তিন চার মিনিট গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল বরফের মত।এক সময় চোখের সামনে যখন গাড়িটা এসে থামল তখন তার দৃষ্টি গেল সেই গাড়িটার দিকে। তাকাতেই তার মনে হল পৃথিবীটা ধবংস হয়ে যাচ্ছে।মাথাটা ভনভন করতে লাগলো, গলা শুকিয়ে গেল, পা কাঁপতে লাগল। খানিকের জন্য তার মনে হল সব স্বপ্ন৷ মিথ্যা। গাড়িতে বউ নিয়ে যে বসে আছে সেটা সুমন না। অন্য কেউ৷
সুমন গাড়িতে মাথা নিচু করে বসে ছিল।সে তাকিয়ে ও দেখেনি যে, একটা ছেলে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে। যার চোখের পানি গাল বেয়ে ঝড়ছে।
তারপর সুমন অনেকবার চেয়েছিল নিবিড়ের সাথে যোগাযোগ করতে৷ কিন্তু সে খোঁজে পায়নি৷ অহনা,সুমন অথবা নিবিড়ের বন্ধু বান্ধব কেউ ই তার খবর রাখেনি। একটা মানুষ বিলিন হয়ে গেল। কেউ তার খবর রাখেনি। এমন কি নিবিড়ের নানা বাড়িতে ও তার কোন খবর ছিল না৷ অহনা এর পরে আর কোন দিন সুমনের সাথে কথা বলেনি। প্রচন্ড অভিমানে সে বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে উঠে গেল। আর ফিরেনি।
এতগুলা বছর হয়ে গেল অথচ সুমন আর কোন দিন তার খবর পাইনি। হারিয়ে গেছে চিরতরে।
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর চলে গেল। সুমন অনেকটা মরে যাওয়ার মত বেঁচে আছে। মিতুর সাথে মিছে মিছে সংসার। লোক দেখানো মিছে সম্পর্ক। পাঁচ বছর আগে যে ছেলেটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তার জন্য তার ভেতরটা সারাক্ষণ কাঁদে৷ইশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা কোন একদিন পথ চলতে চলতে যেন তাদের দেখা হয় যায়।
শূণ্যস্থান
Reviewed by সমপ্রেমের গল্প
on
February 20, 2019
Rating:
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteখুবই সুন্দর লিখেছেন পবিত্র।
ReplyDelete